(২) অন্যটি হচ্ছে পলিসি বা গাইড লাইন এর সঠিক বাস্তবায়ন (Implementation)। যে বা যারা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থেকে কল্পনাকে বাস্তবে নিয়ে আসেন তাদের বলা হয়, স্থান কাল ও কার্যভেদে, প্রশাসক (Administrator) বাস্তবায়নকারি (Implementer) বা ব্যবস্থাপক (Manager)।
পলিসি মেকার ও ম্যানেজার – কার ভূমিকা কতখানি তা নির্ভর করবে উদ্দিষ্ট কর্মের পরিধি, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং সম্ভাব্য অর্জিতব্য ফলাফলের উপর। কর্ম-পরিধির উপর ভিত্তি করে কোন কাজের জন্য এক, একাধিক বা বহু পলিসি মেকার বা ম্যানেজারের প্রয়োজন হতে পারে।
পলিসি মেকার, গবেষক ও প্রশাসক বা এ্যাডমিনিস্ট্রেটর শব্দগুলো অনেক সময় বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে, বিশেষ করে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পরিসরে। সাধারণত জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত (বাংলাদেশের মত গণতান্ত্রিক দেশে) বা রাষ্ট্র কাঠামোয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত এম.পি, মন্ত্রী, কখনো কখনো আমলাদের, বলা হয় পলিসি মেকার। ঠিক একই পদ ও পদাধিকার বলে পদাসীন ব্যক্তিদেরই আবার একটু ভিন্ন পরিস্থিতিতে, যখন তারা নিয়োজিত থাকে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে (যেমন মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের), বলা হয় প্রশাসক বা এক্সিকিউটিং বা বাস্তবায়নকারি কর্তৃপক্ষ হিসাবে। কারণ একই ব্যক্তি যখন হয় মন্ত্রণালয়ে কিংবা জাতিয় সংসদে আইন-প্রণয়নের কাজ করেন তখন তারা পলিসি মেকারের ভূমিকা পালন করেন কিন্তু যখন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকেন তখন ম্যানেজারের ভুমিকা পালন করেন।
সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্পোরেট কালচারে তাই দেখা যায় পলিসি মেকার, গবেষক ও প্রশাসক বা এ্যাডমিনিস্ট্রেটর, ম্যানেজার ইত্যাকার শব্দগুলোর বহুমাত্রিক ব্যবহার। ইসলামি আন্দোলনে এসব শব্দগুলোর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে যেহেতু আমাদের আলোচনা তাই রাষ্ট্র কাঠামো্তে, বিশেষত বাংলাদেশের, এ সব শব্দের প্রচলিত, প্রাসঙ্গিক ও আবশ্যক ব্যবহারবিধিতেই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
প্রাসঙ্গিকভাবেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতের পরিচালনাবিধি একটু দেখে নেয়া যেতে পারে। ব্যাংকিং সেক্টরে সাধারণত মৌলিক সিদ্ধান্তগুলো গৃহীত হয়ে থাকে বোর্ড অফ ডাইরেক্টরস ফোরামে। এরপর এসব সিদ্ধান্ত কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তার পলিসি নির্ধারণ করা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পলিসি মেকারদের নিয়ে। উল্লেখ্য যে, ব্যাংকের চেয়ারম্যান কিংবা মালিক পক্ষ যারা বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে পারদর্শী নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের ভূমিকা অনেকটা জাতিয় সংসদের এম.পি দের মতই। ব্যাংকের মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কিংবা গৃহীত সিদ্ধান্তের আউটলাইন নির্ধারণে যে মূলনীতির প্রয়োজন হয় তা কিন্তু নির্ধারণ দেন ব্যাংকের পলিসি মেকাররা। আর এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের যে কলা-কৌশল নির্ধারণ করে দেয়া হয় তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করেন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার ম্যানেজাররা। উল্লেখ্য, ব্যাংকের ম্যানেজার পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই অনেকেই যোগ্যতা ও দক্ষতা বলে পলিসি মেকিং পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও শাখা ম্যানেজার, এবং পলিসি মেকারদের মধ্যে রয়েছে বিরাট পার্থক্য। ব্যাংকের এমডি একই সাথে যেমন পলিসি মেকিং প্রক্রিয়ার পার্ট তেমনি তিনি এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার নেতৃত্বদানকারি ব্যক্তিও বটে।
ব্যাংকের পলিসি মেকিং পর্যায়েও রয়েছে দুইটি উল্লেখযোগ্য স্তর। এই পরিকল্পনাকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
(ক) স্ট্রাটেজিক পরিকল্পনা (Strtegic planning)
(খ) অপারেশনাল পরিকল্পনা (Operational planning)
স্ট্রাটেজিক পরিকল্পনার স্তরে মৌলিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং অপারেশনাল পরিকল্পনার স্তরে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সেকেন্ডারি বিধিমালার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্ট্রাটেজিক পরিকল্পনার স্তরে মূখ্য ভূমিকা রাখেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংক গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা । এখানে এমডি, ডিএমডি কিংবা উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভুমিকা খুবই নগন্য। অপারেশনাল পরিকল্পনার স্তরে পরবর্তী কিছু ক্ষমতা এমডি, ডিএমডি কিংবা কিছু ক্ষমতা কাস্টমাইজেশনের জন্য ম্যানেজার লেভেলেও বিন্যস্ত করা হয়ে থাকে।
আমরা ইসলামি আন্দোলনের পলিসি মেকিং বলতে ব্যাংক জগতের স্ট্রাটেজিক পরিকল্পনার স্তরের ‘পলিসি মেকিং বডি’কেই মিন করব।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র-পরিচালনা কাঠামোয় এমপি কিংবা মন্ত্রীরা যখন জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের জন্য পলিসি মেকারের ভূমিকা পালন করে তখন তাদের এই ভূমিকা খুবই গৌণ। কারণ যে বিষয়ে তাঁরা হাঁ কিংবা না ভোট দিয়ে আইন প্রণয়ন করেন তাতে তাদের অংশগ্রহণ এতই কম যে অনেকেই কোন বিষয়ে কি উদ্দেশ্যে কি আইন প্রণয়ন করছে তার অনেকটুকুই জানেন না। কারণ দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত হওয়ায় দলীয় প্রধান যে বিষয়ে কোন আইন-প্রণয়ন করে সেখানে মতামত প্রদানের কোন সূযোগ থাকেনা। পরিবর্তে শুধু ইয়েস- নো-ভেরি-গূড মার্কা মতামত দিতে বাধ্য হয়। তাহলে কিভাবে চলে রাষ্ট্রের এত বিশাল কর্মযজ্ঞ?
বিশাল এই রাষ্ট্রব্যবস্থার সচলায়তনে যে অগণিত কর্মযজ্ঞ তার পেছনে রয়েছে এদেশের বিষয়-বিশেষজ্ঞ গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অবদান। যত সব আইন, বিধি-বিধান, অধ্যাদেশ ও নীতিমালা তার সবগুলোই প্রায়ই এসব গবেষকদের সাথে সিভিল, ক্ষেত্র বিশেষে, মিলিটারি বুরোক্রাটদের সম্মেলনেই প্রস্তুতকৃত। এখানে গবেষকদের ভূমিকা হলো মূলত পলিসি বা মূলনীতি ফরমূলেইশন এবং বুরোক্রাটদের ভূমিকা হলো সরকারের পক্ষে একটি সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন। অর্থাৎ রাষ্ট্র বা সরকারের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বিষয় ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও গবেষক দ্বারা প্রণীত হয়ে থাকে যা পরবর্তীতে আমলা ও আইন-প্রণেতাদের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে ঘোষিত বা অনুমোদিত হয়ে থাকে।
এখন যদি বুরোক্রাট আমলা, এম.পি, মন্ত্রী এবং গবেষকদের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে ‘পলিসি মেকিং’ ধরা হয় তাহলে এখানে গবেষকদের ভূমিকা হচ্ছে এই ‘পলিসি মেকিং বডি’র সেন্ট্রাল/ প্রাইমারী এবং আমলা ও এম.পিদের ভূমিকা হচ্ছে পেরিফেরাল/ সেকেন্ডারি। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমলা ও এম.পিদের ভূমিকাই সেন্ট্রাল/ প্রাইমারী এবং গবেষকদের এখানে কোন ভূমিকা নেই বা থাকলেও তা ভিন্ন রুপে এবং এই ভূমিকা প্রকট নয় বরং প্রচ্ছন্ন।
বাংলাদেশের ইসলামপন্থী আন্দোলনের মাঝে রাজনৈতিক ধারার নেতৃত্বদানকারি সংগঠন হচ্ছে (আপাতত) জামায়াতে ইসলামি। জামায়াতের কাজকে কমপ্লিমেন্ট করছে মহিলা জামায়াত, বংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির এবং ইসলামি ছাত্রী সংস্থা।
জামায়াতে ইসলামি তার কর্মকান্ডে ইসলামি ঐতিহ্যের সংরক্ষণ করতে চায় বিধায় দলের নেতৃত্ব পরিবর্তনসহ সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় শুরা সদস্যের ধারণার প্রতিফলন দেখা যায়। জামায়াত- শিবির কিংবা শিবিরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় দেখা যায় যে, এদের সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকে, ভুলভাবে ব্যাখ্যাত ও গৃহীত, শুরা সভায়।
ইসলাম দ্বীন বা ধর্ম হিসাবে যেমনি গ্লোবাল তেমনি ইউনিভার্সালও। ফলে এর মূলনীতিতে সব সময় জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী বা নির্দিষ্ট কোন জাতি-গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক চিন্তার বাইরে একটি আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিফলন দৃশ্যমান হয়। তাই ইসলামের কোন মৌলনীতি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় বিবিধ জ্ঞানের সমাহার। মুসলিম ইতিহাসে দেখা যায়, রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালকদের চার পাশে জ্ঞানী-গূনীদের সমাহার এবং বিভিন্ন বিষয়ক সমস্যা সমাধানে এসব জ্ঞানী ব্যক্তিদের দ্বারস্থ হতে।
সময়ের বিবর্তনে যেহেতু বিশ্ব আজ পরিণত হয়েছে গ্লোবাল ভিলেজে। ফলে এক দেশের আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তো বটেই, জাতীয় পর্যায়ের যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও জড়িত হচ্ছে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার শক্তিশালী দেশ ও জাতিগোষ্ঠী। আজ অন্য দেশকে প্রভাবিত করছে ব্যাপকভাবে। ফলে সোশাল, পলিটিক্যাল, ইনভায়রনমেন্টাল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল, ইকোনোমিকাল কিংবা অন্য যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সাথে বিজড়িত হয়ে থাকছে অন্য কোন দেশ, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা মাল্টি ন্যাশন্যাল কোম্পানির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন না কোন স্বার্থ। বিশেষ করে অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এসব বহুজাতিক কোম্পানি বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম আজ সীমাহীন। ফলে বলতে গেলে, বাংলাদেশের মতো এসব ক্ষুদ্র, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল (?) দেশের রাজনীতি কিংবা, তথাকথিত,সার্বভৌমত্ব আজ হুমকীর সম্মুখীন।
পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক প্রফেসর হান্টিংটনের ‘ক্লাশ অফ সিভিলাইজেশন’ এর অনুসরণ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর জন্য বয়ে এনেছে আরেক নতুন জটিলতা । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামি চেতনার বিকাশ কে দেখা হচ্ছে পশ্চিমাদের সমাজতন্ত্রী পরবর্তীকালীন শত্রু হিসাবে যার রয়েছে পুঁজিবাদী ভিত্তির উদরে লালিত পশ্চিমা সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করার মত বিশ্ববীক্ষা এবং অতীত অভিজ্ঞতা। আবার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামি চেতনার বিকাশে অবদান রেখে চলছে এসব ইসলাম-পন্থী আন্দোলনগুলোই। ফলে এসব ইসলাম-পন্থী আন্দোলনগূলোই আজ পশ্চিমাবিশ্বের মূল শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এদের বিপক্ষে পশ্চিমাদের গৃহীত নীতিমালা ও তার বাস্তবায়নের এক স্পষ্ট চিত্র ফুটে ঊঠেছে ড. এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজম এবং কাভারিং ইসলাম বই এর ছত্র ছত্রে।
ক্যাপিটালিস্টিক সাম্রাজ্যবাদের এই বিশ্বব্যাপি আভিযাত্রা আজও থামেনি, বরং তার গতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। জন পার্কিনের The Secret History of the American Empire (2007) এবং Confessions of an Economic Hit Man (2004) বই দুটিতে ফুটে উঠেছে সাম্রাজবাদী চেহারার প্রকৃত রুপ। ডা. ফাহমিদুর রহমানের “সাম্রাজ্যবাদ” বই-এও ইসলামি আন্দোলনসহ সকল মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নানান ষড়যন্ত্রের চিত্র পরিলক্ষিত হয়।
এসব কারণে দেশে দেশে ইসলামি আন্দোলনের, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে, কর্মকান্ড পরিচালনা করা আজ অপেক্ষাকৃত কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট দেশের বিরোধী দল কিংবা ব্যবসায়িক গোষ্ঠিই নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতি, বহুজাতিক কোম্পানি, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ মোকাবিলা করে আজ ইসলাম-পন্থী আন্দোলন কে টিকে থাকার কসরত করতে হচ্ছে।
ফলে সংগঠন হিসাবে ইসলামপন্থী দলগুলো ন্যাশনাল পর্যায়ের হলেও তাদের লড়াই হয়ে পড়েছে, বাধ্যতামূলকভাবে গ্লোবাল। ইসলাম-পন্থী আন্দোলনের জন্য লড়াই হয়ে পড়েছে যতটা না ফিজিক্যাল, তার চেয়ে অনেক বেশি ভার্চুয়াল ও ইন্টেলেচুয়াল, যতটা না ভিজিবল তার চেয়ে বেশি ইনভিজিবল। আর গ্লোবাল, ইন্টেলেকচুয়াল, ইনভিজিবল ও ভার্চুয়াল এই যুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন ইন্টেলেকচুয়াল সুপারিওরিটি অর্জন করা। ইন্টেলেকচুয়াল সুপারিওরিটি অর্জন করতে হলে চাই ইন্টেলেকচুয়াল ব্যাকড/প্রিপেয়ার্ড পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সুদক্ষ, সুচিন্তিত, বাস্তবায়নযোগ্য নীতিমালা।
কেমন হতে পারে ইন্টেলেকচুয়াল ব্যাকড/প্রিপেয়ার্ড পরিকল্পনা? এর উত্তরে, বোধ হয়, ড. তারিক রামাযানের বিখ্যাত উক্তিটিই প্রণিধানযোগ্য-
The integration of ulama-al waqi (Context Scholar) into fiqh counsils has become imperative and should make it possible to broaden the horizons of Ulema an nusus (Text Scholar) so that scientific stakes can be perceived both globally and historically. (Radical reform, p131)
২০০৫ সালের সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরে ড. আহমেদ তুতুনজির যে বক্তব্য ছিল তা অসাধারণ এবং তিনি যে ছায়া মন্ত্রী সভা গঠনের কথা বলেছিলেন তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কাংখিত যোগ্যতাসম্পন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক লোক তৈরি করা, যা ইন্টেলেকচুয়াল ব্যাকড/প্রিপেয়ার্ড পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য। তিনি আরো বলেনঃ
We do not give much emphasis on research and development (R&D) and therefore we cannot formulate appropriate strategy to defend our rights and are exploited by others”. He called upon the new generation “to be innovative and achieve excellence; to put an extra effort whenever work demanded and become the master of one’s own profession and achieve the best possible”
বাংলাদেশে ইসলামপন্থী আন্দোলনে তথা জামায়াত, শিবির এবং ছাত্রী সংস্থার সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে পদ্ধতি তাতে দেখা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব সংগঠনের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় সুরা সদস্য, কিংবা / এবং কাপ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে। এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ বডির (Policy making body) অধিকাংশ সদস্যই সাধারণ আলেম কিংবা কোন বিষয়ে নরমাল অনার্স বা মাস্টার্স ডিগ্রধারী; বিষয় বিশেষজ্ঞ তো নয়, এমন কি ইসলামি ফিকহের যে মিনিমাম স্টান্ডার্ড থাকা দরকার তাও অনেকের নেই। ন্যাশনাল বাউন্ডারির বাইরে গ্লোবাল জগতের যে চিন্তা তা তাদের চিন্তারও অতীত। জামায়াতের আগের মুরুব্বী তথা দায়িত্বশীলদের মধ্যে অভিজ্ঞতা কিংবা ইসলামি উসুলের জ্ঞান (?) থাকলেও শিবির ও ছাত্রী সংস্থার অবস্থা খুবই করূণ। এখানে অধিকাংশই ভার্সিটি কিংবা অনার্স/ মাস্টার্স লেভেলের ছাত্র-ছাত্রী।
যে ইসলামপন্থী আন্দোলনের প্রধান বাধা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিরোধী দল, মত, সাম্রাজ্যবাদি শক্তির লালিত-পালিত সিভিল সোসাইটি, পুঁজিবাদি চেতনাপুষ্ট কর্পোরেট ব্যবসা-বাণিজ্য, মাল্টি-ন্যাশন্যাল কোম্পানি এবং পশ্চিমা মদদপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সেবাদানকারী এনজিও সমূহ তাদের আদর্শের বিপরীতে সুপরিকল্পিত প্ল্যান, দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্প-মেয়াদি বাস্তবায়ন কৌশল, সঠিক মনিটরিং ও মূল্যায়ন এবং টাইম টু টাইম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশলের যাচাই ও রি-এ্যাসেসমেন্ট ছাড়া এভাবে হুট-হাট করে, অন-দ্যা স্পট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করা কতটুকু কার্যকর তা আমাদের পুনর্বিবেচনা করে দেখা দরকার।
ইসলামি আন্দোলনের যে কর্ম-পরিধি, যে কর্মকৌশল এবং যে বুদ্ধিবৃত্তিক মন ও মননশীলতার দরকার তার জন্য প্রয়োজন এক বাস্তবসম্মত, সুপরিকল্পিত, সুচিন্তিত ও সুবিন্যস্ত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (Perspective plan) এবং সে পরিকল্পনার আলোকে স্বল্প-মেয়াদি চতুর্শালা কিংবা পঞ্চশালা (four/five years plan) এবং তার আলোকে এক শালা, দ্বিশালা, ষান্মাশিক, ত্রৈমাসিক, মাসিক এমন কি দৈনিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং পরিকল্পনা মোতাবেক গৃহীত স্ট্রাটেজি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা।
এই পরিকল্পনা গ্রহণের সময় যেহেতু জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি, সমাজনীতি, ফিকহনীতি ও অন্যান্য এ্যান্থ্রোপলিজিক্যাল বিষয় সামনে রাখতে হয় তাই এসব পলিসি মেকিং এর জন্য আবশ্যক হবে দক্ষ, যোগ্য, বিষয়-বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। আর এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন এক দল তরুণ, শারিরীক ও মানসিক দিক থেকে সুস্থ, ইসলামের সঠিক জ্ঞান ও চেতনায় ভরপুর এবং বিশ্বব্যাপি মানবতার সমস্যা সমাধানের এবং মানুষের জীবন-যাত্রার মানোন্নয়নের চিন্তায় মশগুল, পেরেশান এক দল লোক, মাওলানা মওদুদীর ভাষায় এক দল বদ্ধ পাগল, যারা হাসি মুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয়ার সাহস রাখে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং বাংলাদেশের ইসলামি আন্দোলনের বাস্তবতায় যে বিষয়টি এখন সামনে দৃশ্যমান তা হচ্ছে-
“ইসলামি আন্দোলনে যাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা ছিল তথা ম্যানেজারের ভূমিকা পালনের কথা ছিল তারা একই সাথে ম্যানেজারের ভূমিকা এবং পলিসি মেকারের ভূমিকা পালন করছে। কারণ বর্তমানে আন্দোলনে যারাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তারাই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। হাঁ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ একেবারে থাকবেনা এমন নয়, তবে অংশগ্রহণের পরিবর্তে তারাই হয়ে পড়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ার হর্তা-কর্তা, দন্ড-মুন্ডের কর্তা।
জামায়াতের ক্ষেত্রে জামায়াতের আমির, শিবির ও ছাত্রী সংস্থার ক্ষেত্রে শিবির ও ছাত্রী সংস্থার প্রধানরা হচ্ছে বাস্তবায়নকারি কর্তৃপক্ষ বা ম্যানেজার এর ভূমিকা পালনকারি। কার্যত, প্রয়োজন হলে ব্যাংকের মত পলিসি মেকিং বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এসব দল-নেতাদের অংশগ্রহণ থাকতে পারে, তবে কখনোই তাদের দন্ড-মুন্ডের কর্তা হওয়া বাঞ্চিত নয়।
ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যে প্রেক্ষিত ও অন্যান্য স্বল্প-মেয়াদি পরিকল্পনা তা মনিটরিং এবং মূল্যায়নের দায়িত্ব স্থায়ী ভাবে একই মূলনীতিতে (উন্নত দেশের বৈদেশিক মূলনীতির ন্যায়- যেখানে দেখা যায় যে, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন তাদের ফরেন পলিসির তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন হয় না, যেমন ভারত, চীন কিংবা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র) (সঠিক ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল অনুসারে) পরিচালিত হলে তা থেকে প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জন যেমনি সহজতর হবে তেমনি নেতৃত্বের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিকল্পনা পরিবর্তনের যে হিড়িক তা বন্ধ হবে এবং ইস্লামি আন্দোলনের গতিধারা সাবলীল ভাবে চলতে থাকবে”।
বাংলাদেশের ইসলামপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্ব পর্যায়ের শ্রম বিভাজনে তাই আজ একটি আমুল পরিবর্তন দরকার। দরকার স্থান ও কালের প্রেক্ষিতে স্ব স্ব দায়িত্ব নির্ধারণ-পূর্বক টিওআর (টার্মস অফ রেফারেন্স) চূড়ান্ত করা এবং পলিসি মেকিং এর কাজে পলিসি মেকারদের এবং পলিসি বাস্তবায়নের কাজে বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ তথা উপযুক্ত ম্যানেজার পর্যায়ের লোক কে দায়িত্ব প্রদান করে, সে মোতাবেক, সকল কার্যসূচি বাস্তবায়নের জন্য সঠিক মনিটরিং এবং মূল্যায়নের (monitoring and evaluation) ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
*******************************