[গত ১৫ই মার্চ, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় ইউআইটিএস (University of
Information Technology and Sciences-UITS) এর ২য় সমাবর্তন। এটি অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ বংগবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা হিসাবে বক্তব্য রাখেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রুপকার, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডা তুন মাহাথির বিন মুহাম্মদ। তিনি মাত্র সাত মিনিটে তার সমাবর্তন বক্তব্য শেষ করেন। এই বক্তব্যেই তিনি মুসলিম জাতির পশ্চাদপদতার বিষয়টি এবং
তার সঠিক কারণ হিসাবে ‘বিজ্ঞান চর্চা না করার’ বিষয়টি তুলে ধরেন। বিজ্ঞান চর্চা পরিত্যাগ করার ফলে মুসলিম জাতি যে শাসকের স্থান হতে শাসিতের স্থানে অবনমিত হয়েছে সে বিষয়টি তিনি অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেন। মাহাথিরের মতে, শুধু রিচুয়ালিস্টিক ধর্ম চর্চা নয় বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাও ইসলামের অন্যতম নির্দেশ। তাই ধর্মের রিচুয়ালিস্টিক বিধি-বিধানের পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সবাইকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান। নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি গোটা মুসলিম জাতির উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য তিনি ইউআইটিএস এর গ্রাজুয়েটদের প্রতি আহবান জানান। ডা তুন মাহাথির বিন মুহাম্মদের এই ভাষণের অনুবাদ করেছেন জনাব আবু সুলাইমান]
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
সন্মানিত সভাপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় রাষ্ট্রপতি এবং ইউআইটিএস’র আচার্য, সন্মানিত শিক্ষামন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ, ইউআইটিএস বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সন্মানিত চেয়ারম্যান জনাব আলহাজ্ব সূফী মিজান, ইউআইটিএস’র উপাচার্য ড. মোহাম্মদ সামাদ, বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দ, গ্রাজুয়েট ডিগ্রী অর্জনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের অবিভাবকবৃন্দ, ভদ্র মহোদয় এবং মহোদয়াবৃন্দ
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
প্রথমেই আমি ইউআইটিএস কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষ করে, ইউআইটিএস বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সন্মানিত চেয়ারম্যান জনাব আলহাজ্ব সূফী মিজান কে ধন্যবাদ জানাতে চায়
আমাকে এই কনভোকেশনে আমন্ত্রন জানানোর জন্য।
আমি অত্যন্ত খুশি এজন্য যে, এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক জ্ঞানচর্চায় আত্মনিয়োগ করেছে যে শাখার জ্ঞানার্জনকে পাঁচশত বছরের বেশি সময় ধরে মুসলিম উম্মাহ অবহেলা করে আসছে। আমাদের অবশ্যই আমাদের নিজস্ব ধর্মের বিধি-বিধান সম্পর্কে জানতে হবে কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মের আচার-আচারণগত বিষয়ের উপরই আলোকপাত করতে হবে- ঠিক এমন নয় ।
স্রষ্টার প্রথম নাযিলকৃত আদেশ এর মাধ্যমে আমাদেরকে অধ্যায়ন বা গবেষণার’র (ইকরা) জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু এখানে অধ্যায়ন বা গবেষণার’র বিষয়কে শুধু ধর্ম শিক্ষার মাঝে নিদিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। আর যখন রাসুল (সা) প্রথম ওহী প্রাপ্ত হন, তখন ইসলাম নিয়ে অধ্যায়ন বা গবেষণার’র মত কিছু ছিলনা। সুতরাং প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ গ্রীক, ইন্ডিয়ান, চাইনিজ এবং রোমান সভ্যতার সাহিত্য অধ্যয়ন করেছেন এবং তাঁরা এতে উপকৃতও হয়েছেন।
যে চারশত বছর বিজ্ঞান ও গণিত অঙ্গনে মুসলমানদের পদচারণা ছিল সে সময়ের জ্ঞান-গবেষণা থেকে মুসলমানরা উপকৃত হয়েছে ব্যাপক । আর সে সব বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে দক্ষ হওয়ায় আমরা অনন্য উচ্চতার এক ‘সভ্যতা’ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু দু:খজনকভাবে পনের শতকের দিকে কোন কারণ ছাড়াই এটা ধরে নেওয়া হলো যে, বিজ্ঞানের শাখায়
জ্ঞানার্জনের তেমন কোন মূল্য নেই। আমরা যদি মুসলিম উম্মাহ’র ইতিহাসের দিকে নজর দেই তাহলে দেখতে পায়, যে সময় হতে মুসলমানরা গণিত ও বিজ্ঞানের চর্চা ত্যাগ করল সে সময় হতেই মুসলমানরা নানা দিক থেকে দূর্বল হতে শুরু করল।
আর এরই ধারাবাহিকতায় বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকেই সকল মুসলিম দেশ বিদেশী শাসনাধীনে চলে আসে। তারা পরাধীন হয় কারণ তারা নিজেদের শাসন ক্ষমতা কিংবা ধর্ম ‘ইসলাম’ কে সুরক্ষার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল । ফলে তারা আত্মরক্ষা কিংবা ইসলাম রক্ষা কোনটিই করতে পারেনি। আর এর প্রধান কারণ তাদের বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের স্বল্পতা ।
আমাদের নিকট স্পষ্ট যে, পবিত্র কুরআন মুসলিম উম্মাহ ও ইসলাম ধর্ম রক্ষার্থে তাদেরকে প্রস্তুত থাকার আদেশ দিয়েছে। নবী (সা) এর যুগে প্রয়োজনীয় যুদ্ধ সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখার কথা জন্য আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছিল। ফলে সে সময় আমাদের ছিল ঘোড়া, ঢাল-তলোয়ার এবং তীর-ধনুক। কিন্তু আজকের প্রতিরক্ষার জন্য সে সব যথেষ্ঠ নয়। আজ প্রয়োজন আমাদের রকেট, ফাইটার বিমান, যুদ্ধ জাহাজ, সাবমেরিনসহ আরো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি । আর এগুলো অর্জন করতে হলে আবশ্যক বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির জ্ঞান ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞানার্জনে অবহেলা মুসলমানদের পিছিয়ে রেখেছে। ফলে আমাদের নিজস্ব যুদ্ধাস্ত্র ও উদ্ভাবন দিয়ে মুসলিম জাতির নিরাপত্তা প্রদান এখন সম্ভব নয় । আজ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ও রাষ্ট্রগুলোতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তারা বিদেশী দখলদারদের পদানত।
আমরা পরাশক্তির দ্বারা আক্রান্ত। আমাদের জনগণ আজ গণহত্যার স্বীকার। অথচ আমরা কিছুই করতে পারছিনা- কারণ পুরো মুসলিম বিশ্বে প্রায় অর্ধশতাধিক মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে কিন্তু এগুলোর কোন একটি রাষ্ট্রও উন্নত নয়। সকল মুসলিম রাষ্ট্র আজ নিরাপত্তার জন্য কোন না কোন ভাবে বিদেশী রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। কোন মুসলিম দেশের শাসকই আজ জনগণবান্ধব নয়।
এসব কারণে আজ মুসলমানরা কোন আবিস্কার, উদ্ভাবন ও নতুন সৃষ্টিতে অক্ষম। আমরা যদি আমাদের শোষক ও দখলদার দেশের চেয়ে উন্নত উপায়-উপকরণ তৈরী করতে না পারি, কমপক্ষে তাদের মত মানসম্পন্ন কিছু উদ্ভাবন করা দরকার। আমরা জানি, এসব করার মত সামর্থ্য বর্তমানে আমদের নেই, কারণ আমরা বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানে ব্যাপৃত নয়। আধুনিক অস্ত্রপাতি ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানের সকল শাখায় আমাদের পদচারণা।
তথ্য-প্রযুক্তির জ্ঞান আজ আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কারণ তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা গোটা বিশ্বের যে কোন প্রান্তের প্রয়োজনীয় তথ্যজালের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে যে কোন কাজ করতে পারি।
এ কথা ঠিক যে, আমদের অবশ্যই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হবে। কারণ এই জ্ঞান যখন আমাদের চরিত্রে প্রতিফলিত হয় তখন তা অপেক্ষাকৃত ভাল মুসলিম সমাজ বিনির্মাণে সহায়তা করে। অন্যদিকে এ কথাও ঠিক যে, উন্নততর সমাজ বিনির্মাণে বাধাদানের মত কোন বিষয় ইসলামে নেই এবং ইসলাম ধর্মের কোন আদেশই আমদের নিজস্ব প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি নিতে নিষেধ করেনা। আর এ জাতীয় প্রস্তুতির জন্য দরকার জ্ঞানের। আর এ জ্ঞান বলতে শুধু ধর্মের প্রথাগত আচারানুষ্ঠানের জ্ঞানই নয় বরং সমাজ-সভাতার উন্নয়নে অবদান রাখার এবং মুসলিম সমাজের সার্বিক প্রতিরক্ষার জ্ঞানও দরকার।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রিধারী ছাত্র-ছাত্রীদের আমি স্বাগতম জানাই। আমি আশা করি, আজকের স্নাতক ডিগ্রিধারী ছাত্র-ছাত্রীরা এমন অনুপ্রাণিত হবে যে, তারা শুধু নিজেদের ব্যক্তিক উন্নয়নই নয় বরং একটি বৃহত্তর মুসলিম জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবে। আমাদের রয়েছে সক্ষমতা, রয়েছে মেধা। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো, শুধু আখিরাতের প্রস্তুতির নামে কিছু নির্দিষ্ট আমলের উপর গুরুত্বারোপ করে আমরা অনেক সময় ইসলামের মৌলিক অন্যান্য যে নির্দেশামালা তা অবহেলা করি।
এই পৃথিবীর মানব সমাজ ও পরিবেশের প্রতিও রয়েছে আমাদের কিছু দায়িত্ব। ‘ফরজে আইন’ (যা ব্যক্তিকভাবে পালন করা আবশ্যক) ছাড়াও ‘ফরজে কিফায়া’ আমাদেরকে পালন করতে হবে।
‘ফরজে
কিফায়া’ হিসাবে আমাদের উপর সমাজের প্রয়োজন পূরণের যে দায়িত্ব রয়েছে তা যদি আমরা পালন না করি তাহলে সামষ্টিকভাবে আমাদের দায়বদ্ধ (পাপী) হতে হবে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখনই তথ্য-প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করে তখন তারা নিজেদেরকে ইসলাম ও মুসলিম সমাজের প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুত করে।
আমাদের রয়েছে সামর্থ্য, আমাদের রয়েছে মেধা। কিন্তু আমাদের নেই কোন ভিশন। আমি মনে করি, আজকের ছাত্রদেরকে জ্ঞানার্জনের সূযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সেই সকল শাখায় যেখানে রয়েছে আমাদের দূর্বলতা।
আমি নিশ্চিত,
আপনারা
লেখাপড়া
শেষে
যখন
বিশ্ববিদ্যালয়
ছেড়ে
যাবেন, তখন আত্ম-উন্নয়নের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা নিয়োগ করবেন। সবটুকু বিলিয়ে দিবেন আপনাদের ব্যক্তিক এবং মুসলিম উম্মাহর উন্নয়নের জন্য। এটাই আপনাদের দায়িত্ব। আর এ পথে আমি আপনাদের অভিনন্দন জানাই।
সকলকে ধন্যবাদ।
……………………………………