০১. বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব (Theory of Alienation):
সমাজ সংগঠন ও ব্যক্তি-চেতনার
দ্বান্দিক দ্বৈরথে মানুষের চৈতন্যে সৃষ্টি হয় বিচ্ছিন্নতা। সাধারণভাবে, বিচ্ছিন্নতা
বলতে একটি সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা নির্দেশ করে, যেখানে একজন ব্যক্তি সামাজিক
অস্তিত্ত্বের কতিপয় দিক থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে। সমাজ বিজ্ঞানী Melvin
Seeman তার On the meaning of Alienation গ্রন্থে বিচ্ছিন্নতার ৫টি প্রধান লক্ষণ শনাক্ত করেছেন এভাবে-
- কর্তৃত্বহীনতা (powerlessness)
- অর্থহীনতা (meaninglessness)
- আদর্শহীনতা (normlessness)
- সম্পর্কহীনতা (Isolation)
- আত্ম-সংযোগহীনতা (Estrangement)
তাঁর মতে, বিচ্ছিন্নতার মূল অর্থ
হলো ‘to become a stranger to oneself’
কার্ল মার্ক্সের সমাজদর্শন চিন্তার
কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা তত্ব (theory of
Alienation)।
মার্ক্সের মতে, বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানব জাতির অন্যান্য সমস্যার
মূল উৎস। শ্রমিকের বিচ্ছিন্ন শ্রম (alienated labor) এর ধারণাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে তার বিচ্ছিন্নতা
তত্ব।
বিচ্ছিন্ন শ্রমঃ
শ্রমিকের শ্রম অধিকার যখন তার নিজের
নিয়ন্ত্রণে থাকেনা, পরিণত হয় মালিকের পণ্য-উৎপাদনের শক্তি রুপে, তাকেই মার্ক্স
বিচ্ছিন্ন শ্রম বলে আখ্যায়ত করেছেন।
মার্ক্সের
মতে পুঁজিবাদী সমাজে চার ধরণের বিচ্ছিন্নতা পরিলক্ষিত হয়-
- কর্ম বা কর্ম পদ্ধতি থেকে বিচ্ছিন্নতা,
- উৎপন্ন সামগ্রী হতে বিচ্ছিন্নতা,
- আপন সত্ত্বা হতে বিচ্ছিন্নতা এবং
- মানব-প্রকৃতি তথা মানবিক সামাজিক সম্পর্ক হতে বিচ্ছিন্নতা।
এই চার ধরণের বিচ্ছিন্নতার মুল কারণ
হচ্ছে শ্রমের ফসল হতে বিচ্ছন্নতা। শ্রমের ফসল হতে বিচ্ছিন্নতাই ক্রমে মানুষ কে অপর
মানুষ এবং তার আপন সত্তা হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
আর এর মূল হচ্ছে সামাজিক শোষণ যা সমাজে মানুষ কে মানুষ-শ্রমিক হতে পশু-শ্রমিকে পরিণত করে।
মার্ক্সের মতে, পুঁজিবাদী সমাজে মানব
সত্তা হতে মানুষের এই বিচ্ছিনতাই সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সত্ত্ব বা ওনারশিপ এর ধারণাই জন্ম
দেয় বিচ্ছিনতার। কারণ শোষক শ্রেণী means of
Production নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সকল
সম্পদের ownership করে। আর এসবের মুলে রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা (Concept of Private property)। ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা বিকশিত হবার সাথে সাথে মানুষের বিচ্ছিন্নতাও
প্রকট হতে প্রকটতর হয়েছে।
০২. দ্বন্দবাদ কি (What is dialectism)?
ডায়ালেক্টিজম এর মূল কথা হচ্ছে-
প্রকৃতি জগত ও মানব্জগতের সব কিছুই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে পরস্পর
সম্পর্কিত।
দ্বন্দবাদ বা দ্বান্দিক পদ্ধতি
দর্শনশাস্ত্র আলোচনার একটি গুরুত্বপুর্ণ পদ্ধতি। এই পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য
হল এই যে, এর মধ্যে আবশ্যিকভাবে সব সময় বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে একটি দ্বন্দ বা
পরস্পর বিরোধীতা কাজ করে।
দ্বন্দবাদ বা দ্বান্দিক পদ্ধতির জনক
ফ্রেডরিক হেগেল। তিনিই প্রথম দ্বন্দবাদ বা দ্বান্দিক পদ্ধতির ব্যাখ্যা করেন।
দ্বন্দবাদ শুধু দ্বন্দ বা সংঘর্ষের
মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর মধ্যে পরিবর্তন ও গতির দ্যোতনা বিদ্যামান। এটি পদ্ধতি বা
মাধ্যম ছাড়াই আর কিছুই নয়। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, দ্বান্দকতার মাধ্যমে বিশ্বসত্তার
যথার্থ স্বরুপ নিরুপন করা। কিন্তু পরিবর্তন ও গতি ছাড়া এই লক্ষ্যে উপনীট হওয়া
মোটেই সম্ভব নয়। বস্তুত দ্বন্দ, পরিবর্তন ও গতি পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
(আয়েশ উদ্দীন, রাষ্ট্রচিন্তা
পরিচিতি, পৃষ্ঠা-৪৬০-৬১)
১৯১২ সালে প্রকাশিত The science of Logic গ্রন্থে হেগেল ডায়ালেক্টিট তত্ত্বটি
বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। “প্রকৃতির মাঝে যে অন্তর্নিহিত স্ববিরোধ তার কারণে সকল
বস্তুই অবিরাম গতির মধ্যে সর্বদা পরিবর্তনশীল থাকে”। ব্যক্তি, ইতিহাস ও চিন্তার
বিকাশের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনশীল গতিই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
দ্বন্দ বা সংঘর্ষকেই (Contradictions)
কেই হেগেল বিবর্তনের প্রধান কারণ বলে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে সংঘর্ষ ব্যতীত
কোন উন্নয়ন সম্ভব নয়।
হেগেলের মতে, পৃথিবীতে, বাস্তবতায়,
চিন্তায়-সর্বত্রই সংঘর্ষ বিরাজমান। বিপরীত উপাদান বা প্রবণতার মধ্যেই পরিবর্তন ও
উন্নয়নমুখী সংঘর্ষের অস্তিত্ব বর্তমান। হেগেলের মতে এই তিনটি সুত্র প্রণয়ন করেছেন-
প্রথম পর্যায়- পজ়িটিভ ডায়ালেক্টিকঃ
এর কাজ হলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে জগৎ সত্তার যথার্থ স্বরুপ নিরুপন করা। এর মাধ্যমে ভাবের
জগতে একটি ধারণা বা আসতি (Thesis) গড়ে উঠে।
দ্বিতীয় পর্যায়- নেগেটিভ
ডায়ালেক্টিকঃ জগৎসত্তার কোন বিষয়ে যে ধারণা গড়ে উঠে তার বিপ্রীত ধারণা তৈরী হয়
যাকে নাস্তি (Anti-Thesis) বলা যায়।
তৃতীয় পর্যায়- নেতির নেতিকরণ (Negation of the negation):
ধারণা ও বিপরীত ধারণা পাশাপাশি চলতে থাকলে এক সময় দুয়ের মধ্যে সংঘর্ষ তৈরী হয় এবং
এই সংঘর্ষে ধারণা ও বিপরীত ধারণা দুটিই ধ্বংস হয়ে যায় এবং তার জায়গায় একটি নূতন
সমন্বিত ধারণা বা সংশ্লেষণের (Synthesis)
তৈরী হয়।
কালক্রমে এই সমন্বিত ধারণা বা সংশ্লেষণই আবার একটি
ধারণাই পরিণত হয় এবং তার বিপরীত ধারণা গড়ে উঠে। বার তাদের ভেতর সংঘর্ষ তৈরী হয় এবং
নূতন সংশ্লেষণের সৃষ্টি হয়। এভাবে চক্রাকার গতিতে বিবর্তনের পথ ধরে সংঘর্ষ ও
সমন্বয় এর পথ ধরে মানুষের জ্ঞান পরম ভাববাদে (Absolute Idealism) গিয়ে উপনীত হয়।
০৩. ভাববাদঃ
হেগেলের মতে,
বস্তুর আগেই আসে ভাব। অতএব, ভাবই হচ্ছে সমস্ত দর্শনের মূল উৎস। এটিই ভাববাদ।
০৪. বস্তুবাদঃ
মার্ক্সের মতে, বস্তুই মানুষের প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি
রেখে নূতন ভাবের সৃষ্টি করে। বস্তু জগতই আদি এবং মানুষের সব ধরণের চিন্তাধারার মৌল
উৎস হচ্ছে বস্তুর অস্তিত্ব। বস্তু দেখেই মানূষের মনে বা চিন্তার জগতে ভাবের উদয়
হয়। তাই ভাবই আগে আসে।
বস্তুবাদ অনুসারে এই জগৎকে সামগ্রিকভাবে বস্তু হিসাবে
বিবেচনা করা হয়। বস্তুবাদ অনুযায়ী, এই বস্তুজগৎ হলো গতিশীল ও সর্বদা পরিবর্তনশীল।
প্রকৃতির মাঝে যে অন্তর্নিহিত স্ববিরোধ বর্তমান তার ফলে বস্তুজগতের পরিবর্তন ও
বিকাশ ঘটে। বস্তু জগতের এই পরিবর্তন ও বিকাশ হলো পরস্পর বিরোধী প্রাকৃতিক শক্তির
ঘাত-প্রতিঘাতের ফল।
মার্ক্সের মতে, দ্বন্দমুলক বস্তুবাদের বিধান হল
বিশ্বজনীন। এই বিধান সমাজ ও প্রকৃতির ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করা যায়। অন্যদিকে,
মানুষের চিন্তা-ধারাকেও নিয়ন্ত্রণ করে এই বিধান।
এই হলো ভাববাদ ও বস্তুবাদ সম্পর্কে একটি সাদামাটা ধারণা।
০৫. দ্বান্দিক ভাববাদ (Dialectic Idealism) ও দ্বান্দিক বস্তুবাদ (Dialectic Materialism)
কি?
দর্শন জগতের দুই দার্শনিকের বিখ্যাত দুই দর্শন হচ্ছে
দ্বান্দিক ভাববাদ ও দ্বান্দিক বস্তুবাদ।
ফ্রেডরিক হেগেল দেন দ্বান্দিক ভাববাদ তত্ত্ব এবং কার্ল মার্ক্স দেন দ্বান্দিক
বস্তুবাদ। আঠার শতকের পর থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত এ দু দর্শনের চলছে চরম রাজত্ব।
দর্শনের লক্ষ্য
ও কেন্দ্রবিন্দুঃ
Philosophy of Rights বই-এ হেগেল বলেছেন- জড় জগতই হচ্ছে জ্ঞান ও দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ও মূল
লক্ষ্য। জ্ঞানের কাজ হচ্ছে প্রকৃতির (nature) মধ্যে যে ‘শ্বাশত
ঐক্যতান’ (Eternal Harmony) ও ‘সহজাত
যুক্তিবাদিতা’ (Inherent Rationality) লুকিয়ে রয়েছে তা খুঁজে বের করা।
(আয়েশ উদ্দীন, রাষ্ট্রচিন্তা পরিচিতি,
পৃষ্ঠা-৪৬০)
|
ভাববাদ ও
বস্তুবাদের ধারণা দিতে গিয়ে হেগেল ও মার্ক্স যে পদ্ধতিতে কাজ করেছেন তা এক।
কিন্তু একটি মাত্র ধারণার পার্থক্যের কারণে এক জন হলেন ভাববাদের জনক (Father of Idealism/Absolute
idealism) এবং অন্যজন হলেন বস্তুবাদের জনক (Father of Materialism)। একই পথ দিয়ে যাত্রা করেও দুজনের গন্তব্য দু বিপরীত মেরুতে। একজন
বিভিন্ন বিষয়ে দিলেন ভাববাদী বা আদর্শবাদী ব্যাখ্যা, অন্যজন দিলেন জড়বাদী বা
বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যা।
যে ধারণার
পার্থক্যের কারণে হেগেল এবং মার্ক্স দু বিপরীত তত্ব দিয়েছেন সে ধারণাটি হচ্ছে-
“প্রকৃতিতে বিরাজমান মৌলিক সত্তা কোনটি?”।
হেগেলের মতে মূল সত্তা হচ্ছে ‘ভাব’ বা ‘চিন্তা’ বা ‘ধারণা’ (Idea or
thought), কিন্তু মার্ক্সের মতে মূল সত্তা বা
ভাব হচ্ছে জড় বস্তু (Materials)।
হেগেলের মতে, চিন্তা বা ধারণাই হলো জগৎস্রষ্টা এবং
প্রকৃত জগত হচ্ছে এক “মন”নির্ভর জগৎ। তার মতে, মন-ই হচ্ছে একমাত্র সত্তা, এবং
এদিক দিয়ে জড় জগতের অস্তিত্ব মনের উপর নির্ভরশীল।
মার্ক্সের মতে, ‘বস্তু’ বা ‘জড়’ই একমাত্র সত্তা এবং মন
বা ধারণা জড় বস্তুর উপর নির্ভরশীল। মানুষ তার মনের সাহায্যে জড় জগৎকে জানার
চেষ্টা করে।
|
দ্বান্দিক ভাববাদ ও দ্বান্দিক বস্তুবাদ এর
মৌলিক সূত্রঃ
দার্শনিকরা জগৎসত্তা সম্পর্কে জানতে গিয়ে যে একক
ধারণাকে মুল ভিত্তি হিসাবে ধরেন তা হচ্ছে- “আমাদের যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা
দ্বান্দিক পদ্ধতিতে বিবর্তনের পথ ধরে অগ্রসর হয়।”
|