মূলঃ ড.
ঈব্রাহিম
সাঈদ
অনুবাদঃ আবু সুলাইমান
(
ড.
ঈব্রাহিম
সাঈদ
কর্তৃক
১৩ই
আগস্ট,
১৯৯৯
সালে
লুইসভিল
ইসলামিক
সেন্টার,
যুক্তরাষ্ট্র -এ জুম’আর খুতবায় প্রদত্ত ভাষণ। পরবর্তীতে http//www.irfi.org ওয়েবসাইট হতে সংগৃহীত। ১৯৯৯ সালের ভাষণ হওয়ায় তথ্যে পরিসংখ্যানগত কিছু অসংগতি রয়েছে।)
বর্তমানে মুসলমানরা পিছিয়ে আছে
শিক্ষাগতভাবে, সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, এবং এমনকি বৈশ্বিক ক্ষমতার রাজনীতিতেও।
আমাদের প্রয়োজন আত্ম-সমালোচনামূলক অধ্যায়ন। নোবেল পুরস্কার অর্জন, অলিম্পিকে স্বর্ণজয়,
নতুন বই প্রকাশ, কিংবা আর্টিকেল লিখন- সব দিকেই মুসলমানরা পিছিয়ে। মুসলমান সমাজে ১
লক্ষ জনসংখ্যার বিপরীতে বিজ্ঞানী বা গবেষক মাত্র ১জন।
কুরআন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মুসলিম কে পড়ার জন্য এবং
এবং শিক্ষা-গবেষণায় অন্যদের উপর শ্রষ্ঠত্ব অর্জনের নির্দেশ দেয়। এই মসজিদে রাখা আছে
কিছু লিটারেচার। কিন্তু কত জন নামাযী ব্যক্তি সেগুলো হাতে নেয়, পড়াশুনা করে এবং সে
অনুসারে আমল করেন?
বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজে স্বাক্ষরতার হার খুবই কম। আফগানিস্তান,
ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সোমালিয়া, সুদান সব দেশি একই অবস্থা। গৃহযুদ্ধ
বিধ্বস্থ দেশ আফগানিস্তানের অবস্থা খুব নাজুক। মোট জন
গোষ্ঠীর ৫০% হচ্ছে নারী। অথচ আমাদের সে বোনেরা শিক্ষার সূযোগ থাকে বঞ্চিত হচ্ছে।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পাকিস্তানে শিক্ষার হার মাত্র ২৬%।
বিপরীতে ভারতে শিক্ষার হার ৫২%। মুসলিম বিশ্বে পাকিস্তান বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-তে তুলনামূলক
ভাবে বেশ অগ্রসর। পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তি সম্পন্ন একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ।
কিন্ত শিক্ষা ও প্রতিরক্ষা খাতে পাকিস্তানে জিডিপির কত অংশ ব্যয় হয়? আর দূর্নীতির মাধ্যমে
কত অংশ ব্যয় হয়?
মুসলিম বিশ্বে গড় শিক্ষার হার মাত্র ৩৫%। মেয়েদের ক্ষেত্রে
গড় শিক্ষার হার মোট শিক্ষা হারের অর্ধেক। গ্রামীণ এলাকায় এই হার মাত্র ২-৫%। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন নারী গড়ে ১২.৪ বছর স্কুল
শিক্ষার সূযোগ পায়। বাংলাদেশে একজন নারী গড়ে স্কুল শিক্ষার সূযোগ পায় ০.৯ বছর এবং ইয়েমেনে
এই সূযোগ মাত্র ০.২ বছর।
জ্ঞানই শক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র সুপার পাওয়ার।
কিন্তু কেন? কারণ মানব জাতির প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রেই তাদের জ্ঞান রয়েছে। অভিবাসী মুসলিমদের
অধিকাংশই এখানে আসে উচ্চ শক্ষার জন্য। যে কোন উন্নইয়নশীল দেশে গিয়ে একজন ছাত্রকে যদি
আপনি জিজ্ঞেস করেন, শিক্ষার জন্য কোন দেশে যেতে যান? সর্ব সম্মতভাবে উত্তরটি হবে –
যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুপার পাওয়ার। পাওয়ার মানুষকে দূর্নীতি পরায়ন করে
এবং চরম পাওয়ার মানুষকে চরমভাবে দূর্নীতি পরায়ন করে। কোন সন্দেহ নেই যে, আমেরিকার ফরেন
পলিসি সব ক্ষেত্রে একই রকম নয় এবং আমেরিকা কিছু মুসলিম দেশের ব্যাপারে লবিষ্টদের কারণে
কিছু ভুল করে। এমন পরিস্থিতিতে মুসলমানরা কিভাবে অবস্থার উন্নয়ন ঘটাবে। আমাদের অধিকাংশই
এখানে অভিবাসি এবং অভিবাসিদের অনেকেই এখন আমেরিকার নাগরিক। আমাদের ছেলে-মেয়েরা এবং
নাতি- আতনীরা এখানে বেড়ে উঠছে। সহিংসতার মাধ্যমে আমরা কখনোই অবস্থার পরিবর্তন করতে
পারবোনা। যে সহিংসতা সাধারণ নাগরিকদের জীবন নাশ করে, তা ইসলাম কখনো অনুমোদন করেনা।
আমি অনেক ভাই কে দেখেছে যারা পশ্চিমাদের কাফের নামে অভিহিত করে, যেখানে তাদেরকে বলা
হয়েছে ‘আহল আল কিতাব’- কিতাবের অনুসারি। আমরা এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি জ্ঞান,
জ্ঞানানুযায়ী আমল এবং ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে। আমাদের সংঘবদ্ধ হতে হবে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অন্যান্য কমিউনিটি কিভাবে
তাদের অবস্থার পরিবর্তন করেছে এবং সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ঊঠছে তা দেখে আমরা অনেক কিছু শিখতে
পারি।
এক হাজার বছর পূর্বেই আমাদের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন এ্যাস্ট্রোনোমির
গুরু (যেমন- আল বিরুনী, বাত্তানী প্রমুখ)। অথচ আজ আমাদের এই এ্যাস্ট্রোনোমির জ্ঞান
খুবই কম। এ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল মান-মন্দির গুলো নির্মাণ করেছে ক্যালেন্ডার। গত পরশু
দিন আকাশে উঠছে নতুন চাঁদ। সূর্য গ্রহণ হয় যখন চাঁদ সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে অবস্থান করে
এবং তারা একই সরল রেখায় থাকে। এটি হয়ে থাকে চন্দ্রোদয়ের দিন। ১ম চন্দ্রোদয়ের দিন পৃথিবীর
কোথাও চাঁদ কে দেখা যায়না। একে দেখা যায় পরের দিন। চাঁদ দেখা গেছে গত বৃহস্পতিবার এবং
এবং তাই আজ জমাদিউল আউয়াল মাসের ১ম জুমাবার। বিস্ময়কর যে, এই আমেরিকার একই শহরে তিন
টি ভিন্ন ভিন্ন দিনে ঈদ উদযাপিত হয়। এর একমাত্র কারণ অজ্ঞতা। আমাদের দুনিয়া কিংবা দ্বীন
কোনটিরই ভালো যোগ্যতা নেই।
প্রায়ই ৩০ বছর আগে মানুষ চাঁদে গিয়েছে। অনেক মুসলমান চাঁদকে
পবিত্র স্বর্গীয় ঘড়ি হিসেবে বিবেচনা করে। ধর্মপ্রাণ অনেক মুসলমান চাঁদে মানুষের গমন
কে বিশ্বাস করতে চায়না।
এক হাজার পূর্বে মুসলমানরা জ্ঞানের
সকল ক্ষেত্রেই ছিল অগ্রগামি। গোটা বিশ্ব থেকে ছাত্ররা বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য স্পেন,
সিসিলি, কায়রো, বাঘদাদের মুসলিম শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ছুটে আসত।
উদাহরণস্বরুপ-আবু রাইহান আল বিরুনীর
কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঠিক ১০০০ বছর আগের এই দিনে তিনি ২৬ বছর বয়স্ক ছিলেন। গজনীর
সুলতান মাহমুদ আফগানিস্তানে আল বিরূনীর শহর দখল করেন এবং আল বিরুনীকে তার রাজধানীতে
নিয়ে আসেন। সুলতান মাহমুদ শুধুমাত্র একজন বীর বিক্রম বিজেতাই ছিলেননা, তিনি একজন স্কলারও
ছিলেন। এবং তাঁর চারপাশে অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। যেমন- শাহনামর
রচয়িতা ফেরদৌস, আবু রাইহান আল-বিরুণী প্রমুখ। সুলতান মাহমুদ আল-বিরুণীকে সাথে করে ভারতে
নিয়ে আসেন। আল বিরুণী ভারতে ২০ বছর অবস্থান করেন এবং বিভিন্ন পন্ডিত ও স্কলারদের কাছে
বিজ্ঞান, গণিত, দর্শন ইত্যাদি অধ্যায়ন করেন। তিনি সংস্কৃত ভাষা শিক্ষালাভ করেন এবং
Snakhya and patanjali আরবীতে অনুবাদ করেন। তিনি পৃথীবীর ব্যাস ও ব্যাসার্ধ যথাক্রমে পরিমাপ করেন যা ছিল প্রকৃত মাপের °২০ ও
° ২০০ কম বা বেশি। তিনি দেখান যে, পৃথিবী তার নিজস্ব অক্ষে ঘূর্ণনরত। তিনি ব্যাখ্যা করেন, কিভাবে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্র
গ্রহণ ঘটে।
আল বিরুণী একবার একজন পরিব্রাজকের মৃত্যুদন্ড রোধ করেন। সেই পরিব্রাজক সুলতান মাহমুদ কে বলেছিলেন, একটি দেশ আছে যেখানে সূর্য কখনো অস্ত যায়না। এটি হচ্ছে নিশীথ সূর্যের দেশ (land of Midnight sun) । সুলতান মাহমুদ পরিব্রাজক কে ব্লাসফেমীর অভিযোগে অভিযুক্ত করে তার মৃত্যদন্ড ঘোষণা করেছিলেন। তখন আল বিরুণী বিষয়টি সুলতান মাহমুদ কে ব্যাখ্যা করে বোঝান যে, সূর্যের দিকে পৃথীবীর ঝুঁকে থাকার কারণে এই ঘটনা ঘটে থাকে।
আল বিরুণী একবার একজন পরিব্রাজকের মৃত্যুদন্ড রোধ করেন। সেই পরিব্রাজক সুলতান মাহমুদ কে বলেছিলেন, একটি দেশ আছে যেখানে সূর্য কখনো অস্ত যায়না। এটি হচ্ছে নিশীথ সূর্যের দেশ (land of Midnight sun) । সুলতান মাহমুদ পরিব্রাজক কে ব্লাসফেমীর অভিযোগে অভিযুক্ত করে তার মৃত্যদন্ড ঘোষণা করেছিলেন। তখন আল বিরুণী বিষয়টি সুলতান মাহমুদ কে ব্যাখ্যা করে বোঝান যে, সূর্যের দিকে পৃথীবীর ঝুঁকে থাকার কারণে এই ঘটনা ঘটে থাকে।
আমাদের পূর্ব পুরুষদের মত আমাদেরকেও
বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আবিস্কার এবং জ্ঞানে চালকের আসন গ্রহণ করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্জাগরণ-ই
বর্তমানে মুসলমানদের সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন (Intellectual revival of the Muslims
is the need of the hour).
যে কোন পিতামাতার জন্য সবচেয়ে
আনন্দের মুহুর্ত হচ্ছে সে সময়টি যখন তাদের সন্তানরা শিক্ষা, পেশা, ক্ষমতা, সম্পদ ইত্যাদিতে
অন্যকে ছাড়িয়ে যায় কিংবা চমৎকারিত্ব অর্জন করে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে
শিক্ষা। যদি আমি একজন মিডল স্কুল গ্রাজুয়েট হই তাহলে আমার দায়িত্ব হচ্ছে আমার সন্তান
কে হাই স্কুল কিংবা কলেজ গ্রাজুয়েট কিঙবা পোস্ট- গ্রাজুয়েট করানো। যদি আমি একজন কলেজ
গ্রাজুয়েট হই তাহলে আমার দায়িত্ব হচ্ছে আমার সন্তান যাতে ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করতে
পারে তার ব্যবস্থা করা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের কে তার দ্বীন তথা বিধি-বিধান
বুঝা এবং তা অনুসরণ করার সূযোগ দান করুন। আমিন।
সমাপ্ত