Thursday, October 3, 2013

গান ও মিউজিক সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

(বিঃদ্রঃ-বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ঈসমাইল হোসেন সিরাজীর
 রচনাসমগ্র হতে সংগৃহীত এবং কম্পোজকৃত, পৃষ্ঠাঃ )

ভরা বর্ষা । বিপুল জল-প্রবাহে উচ্ছসিত গা দুইকূল বিপ্লাবিত করিয়া সর্ববিঘ্ন বিমদিনী গতিতে কলকলনাদে বায়ুপ্রবাহে বক্ষে রাশি রাশি বিচিত্রমালা ধারণ করিয়া অবিশ্রান্ত গতিতে বহিয়া যাইতেছে।

তখন সন্ধাকাল। পশ্চিমাকাশে নানা বর্ণানুরঞ্জিত জলদমালা বায়ু-সাগরে সন্তরণ করিয়া চিত্ত-বিমোহন নানা দৃশ্যের অবতারণা করিতেছিল। অস্তমান অংশুমালীর রক্তিমাচ্ছটায় বহু র্দণ্ড পযন্ত গগনমগুল আরক্ত হইয়াছিল। রক্তিমার প্রান্তে একপার্শ্বে উজ্জ্বল নীলিমায় এবং অন্যদিকে পিঙ্গলবর্ণেও বিচিত্র বিন্যাসে অপূর্ব শোভা ফুটিয়া উঠিয়াছিল। আকাশের শোভা ধরণী-বক্ষে প্রতিফলিত হইয়া গঙ্গাকেও বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত করিয়াছিল। এমনি মনোহর মধুর সন্ধায় বর্ষার বিপুল জল-প্রবাহে গঙ্গাবক্ষে একখানি পিনির নৌকা তরঙ্গ-তালে দুলিতে দুলিতে মুর্শিদাবাদের নীচ দিয়া যাইতেছিল। প্রকৃতির মনোমোহন দৃশ্য দর্শনে নৌকারোহী শওকত আলী চৌধুরীর মনে সঙ্গীতানুরাগ জাগিয়া উঠিল। তিনি এসরাজের বাকস খুলিয়া মৃদুমন্দ বাদন আরম্ভ করিলেন। তাঁহার সঙ্গী তবলচি ওসমান গনি এসরাজের সঙ্গে তবলের তাল দিতে লাগিলেন । সেই মধুর সন্ধায় পাল-বাহিত নৌকার স্বচ্ছন্দ অবাধগতির সঙ্গে সঙ্গে হৃষ্টমনে শওকত আলী তাঁহার বীণা-বিনিন্দিতকন্ঠে গান গাহিতে লাগিলেন।

গান শুনিয়া সকলেই বিশুদ্ধ আনন্দ ও নির্মল ভক্তিরসে আপ্লুত হ’তে লাগিলেন । গান থামিয়া পক্ককেশ খোন্দকার মোল্লা আফসার উদ্দীন রলিয়া উঠিলেন,“জনাব শওকত আলী সাহেব । আপনি আলেম মানুষ এবং ‘ফখরুল মুহদ্দিসীন’ উপাধি পেয়েও এসরাজ বাজিয়ে গান গাহেন,এটা একান্তই দু:খ ও আফসোসের বিষয়। আপনার পক্ষে এটা নিতান্ত অন্যায়।” 

শওকত আলী- কেন, খোন্দকার সাহেব? কি অপরাধ হল?

খোন্দকার- গান কি ইসলামে হারাম নহে?

শওকত আলী- মোটেই নয়। কখনও না। সঙ্গীতই বিশ্বের প্রাণ, সঙ্গীত ভক্তিলাভের প্রধানতম উপায়। ওলী-আল্লাহ এবং সূফীদিগের সাধনার চরম সহায় হচ্ছে সঙ্গীত। ইসলাম সঙ্গীতকে সর্ববিষয়েই প্রাধান্য দিয়েছে। রুদ, সরোদ, এসরাজ, সারঙ্গ, সেতার, তান্বুরা, তবলা প্রভৃতি অসংখ্য প্রকারের বাদ্যযন্ত্র এবং অসংখ্য সঙ্গীতের রাগ-রাগিণীর অধিকাংশই মুসলমানদের সৃষ্ট।

খোন্দকার- সৃষ্ট হ’লেই যে বিধিসঙ্গত হ’বে, তার তো কোন অর্থ নাই । মৌজুদ আছে। ইসলামের গোড়াতেই সঙ্গীত। কোরআন শরীফের কেরাত শুনেছেন ত? এটা সঙ্গীত ব্যতীত আর কি ? সঙ্গীত নিষিদ্ধ বা হারাম হ’লে কেরাত করে কোরআন শরীফ পড়াও হারাম হ’ত।

আজানও দীর্ঘ আপ্লুত কন্ঠে দিতে হয়। এতে যতটা রাগিণী টানতে হয়, কোনো সঙ্গীতে ততটা রাগিণী টাণতে হয় না ।

খোন্দকার- মোল্লারা বলেন, আজান ও কোরআন পাঠের জন্যে উহা জায়েজ, অন্যত্র নহে।

শওকত- তাঁরা মিথ্যা বলেন। তাঁরা সুর করে দরুদপাঠ করেন কেন ? মোল্লারা তো ওয়াজ-নসিহত করতেও সুর ধরে করেন। গজল তো সর্বদাই তাদের মুখে লেগেই আছে।

খোন্দকার- গজল গাওয়ায় দোষ নাই। 

শওকত- চমৎকার বুদ্ধি। ফাসীতে যাকে ‘গজল’ বলে, বাঙ্গলায় তাকেই ‘গান’ বলে। যার নাম ‘গুল’ তারই নাম ‘ফুল’। নাম ল’য়ে মারামারি করা চরম মূর্খতার পরিচায়ক ।

খোন্দকার- আমার মনে হয়, গান না করাই ভালো। গজল অনেকেই বোঝে না । গান সকলেই বোঝে।

শওকত- তবে আপনি না- বোঝাটাই ভালো মনে করেন। বোঝাটায় দোষ। সঙ্গীতের অর্থ না বুঝলে সে সঙ্গীত শুনে কোন লাভ নাই । আপনার বুদ্ধিও বালাই লয়ে মরি। না বুঝলে ভাব জাগবে কিসে ? আর ভাব না জাগলে ভক্তিনিষ্ঠা বা প্রেম আসবে কোথা হ’তে ? যে মানুষের প্রাণে- সঙ্গীত-রাগিণী সর্বদা বাজে না, সে কখনও খোদা-প্রেমিক হ’তে পারে না। মানুষের প্রাণে-বীণায় ভাবের ঝঙ্কার জাগিয়ে তুলবার জন্যই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতালা প্রকৃতির মর্মে মর্মে সঙ্গীতের সুধাধারা ঢেলে দিয়েছেন। নদীর জল-প্রবাহে মধুর কল্লোল। সমীকরণের গতি-প্রবাহে স্বন স্বন স্বর। পাখীর মধুরকন্ঠে সুললিত তান। ভ্রমরের পক্ষসঞ্চালনে মধুর গুঞ্জন। ঝিঁঝি পোকার তালে সর্বদা তানপুরা বাজছে। অগ্নির প্রজ্বলনেও শোঁ শোঁ সুরে গাঁথা, সুরে বাঁধা এবং সুরেই জীবন । এ জন্যই কোরআন শরী বলেছে.“ সব্বাহা লিল্লাহে মাফিস সমাওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদি ওয়া হুয়াল আজীজুল হাকিম ” অর্থাৎ আকাশ ও ধরিত্রীর প্রতি পদার্থ পরমেশ্বরের সর্বোপরি ক্ষমতাশালী শাসক এবং সৃষ্টির চরম ও পরম বন্ধু বলে তাঁর গুণকীর্তন করছে। এই যে, সৃষ্টির গুণকীর্তন, এটা বিশ্বব্যাপী । এটাকে মহাসঙ্গীতের মহাতান ব্যাতীত আর কিছুই নহে। সাধকের কাছে এটাই জেকরে আসলী। এটাই হিন্দু-শাস্ত্রের ‘প্রণব’ বা ‘ওঙ্কার’। এটাই বাবা নানক সাহেবের “অনাহূত শব্দ বাজস্ত ভেরি।“ সাধনায় সিদ্ধিলাভের পরে ওলী-আল্লারা এই জেকওে আসলী সর্বদা শুনতে পান। এটা আমাদের অন্ত:করণেও সর্বদা উদ্গত হচ্ছে। আপনার যাকে Palpitation of Hearts বলেন, সাধকের কাছে তাই Palpitation of thoughts নামে অভিহিত এবং Vibration মূলত একই জিনিস । পৃথিবীর প্রতি পর্দার্থেও এই Vibration আছে। এই Vibration এর সাহায্যে নিখিল বিশ্ব জুড়ে মহাসঙ্গীতের সৃষ্টি করছে। বিজ্ঞান এখনও অত দূরে পৌছতে পারে নাই। কিন্ত সাধকেরা এটা প্রত্যক্ষ করেন। সুতরাং বুঝছেন সঙ্গীত হারাম বললে, সমস্ত বিশ্বই হারাম হ’য়ে যায়। তবে হিংসামূলক বা ব্যভিচারমূলক সঙ্গীত,যা’ বর্বরযুগে আরবেরা কীর্তন করতো তা জায়েজ নহে।

খোন্দকার-তা’হলেই তো বোঝা গেল যে, সমস্ত ঝায়েজ নহে। সঙ্গীতেও হারাম আছে।

শওকত-হারাম তো প্রত্যেক বিষয়েই আছে- নামাজে পর্যন্ত আছে।

খোন্দকার-নামাজে হারাম ?

শওকত- লোক দেখান বা অন্য প্রকারের প্রাথনা বা ধ্যান-ধারণা, কোন লোকের অনিষ্টের জন্য, এরুপ শ্রেণীর আবেদদিগের জন্য আল্লাহতালা “ ওয়াইল” নামক মহাদোজখের সৃষ্টি করেছেন।

খোন্দকার-বিষম সমস্যা। তা’ হ’লে অভক্ত বা অসাধকের জন্য সঙ্গীত চর্চাও তো হারাম।তাকেও দোজখগামী হ’তে হবে? অনেকটা অভিভূত

শওকত-নিশ্চয়ই নহে। সঙ্গীত গাইতে গেলেই অভক্ত অসাধকেও অনেকটা অভিভূ’ত হয়ে পড়তে হয়। যারা শ্রবণ করে, তারা অশিক্ষিত অভাবুক হলেই সঙ্গীতের মোহন সুরে অল্পাধিক পরিমাণে অভিভূত হ’য়ে পড়বেই পড়বে। কাজেই সঙ্গীত জিনিসটা শুধু লোকদেখান হ’তে পারে না। ভাবের সঙ্গে সর্বদাই তার কিছু যোগ আছে। কিন্ত নামাজের বেলায় সর্বদা তা’ ঘটে না। সেখানে ভন্ডামির আশস্কা আছে। কাজেই ওয়াইল দোজখের দুয়ার লোকদেখান বা হিংসাপরায়ণ মানুষদিগের জন্য খোলা রয়েছে। 

খোন্দকার- তা’ হ’লে সঙ্গীত ধর্ম-সাধনার চরম ও পরম সহায় এবং বিধাতার শ্রেষ্ঠতম দান।

শওকত-নিশ্চয়ই। আজমীর শরীফে যেয়ে দেখুন, মগবের এবং এশার নাজাম বাদে সঙ্গীতের কি মহাধুম। ভাবে বিভোর হ’য়ে কত পাষন্ড ব্যক্তি সেখানে গড়াগড়ি যাচ্ছে। মানব-হৃদয়ের উপরে সঙ্গীতের মত কোন পদার্থই কার্যকরী নহে।

খোন্দকার- তবে মোল্লারা সঙ্গীতের বিরুদ্ধে মত পোষণ করে কেন?

শওকত- মূর্খতা ব্যতীত আর কিছুই নহে। বর্তমান মোল্লা-মৌলবীদিগের মধ্যে ইসলামের খবর খুব কম লোকই রাখেন।

খোন্দকার-অনেকে বলেন, সঙ্গীত হারাম নহে, বাজনাটাই হারাম।

শওকত-বাজনা সঙ্গীতের এবং গায়কের সহায়ক। সঙ্গীত জায়েজ হ’লে বাজনাও জায়েজ।

খোন্দকার- মোল্লারা বলে, একতালা দফ বাজান জায়েজ।

শওকত-দফ প্রাচীন বর্বরযুগের বাজনা। এটা দফ দফ শব্দে বাজে বলেই এর নাম দফ হয়েছে। দফের মত নিরস সবাজনা জায়েজ হ’লে হারমনিয়াম,ফ্লুট, রবাব,সেতার, সারেঙ্গ, সরোদ.ব্যাঞ্জো প্রভৃতি যে মহাজায়েজ সে- বিষয়ে কোন সন্দেহই নাই।

খোন্দকার-তবে মোল্লারা সমর্থন করে না কেন ? ঐ সমস্ত বাদ্যযন্ত্র পরে সৃষ্ট হয়েছে বলে মোল্লারা নামায়েজ বলে থাকে। তবে উহা কি জায়েজ হবে?

শওকত-নিশ্চয়ই। মোটা ভাত জায়েজ হ’লে সরু ভাত জায়েজ হ’বে না কেন? অপারগপক্ষে পান্তাভাত যেখানে জায়েজ, পারগপক্ষে পোলাও সেখানে জায়েজ হ’বে না কেন?

খোন্দকার-বুঝলাম। অনেক আলোকে পেলাম। এত দিনে তো এ সব মহাপাপ বলে মনে করতাম।

শওকত- আরে মিঞা। পাপ ও পূণ্যের সংজ্ঞা কি, তাই তো মোল্লারা অবগত নয়। 

খোন্দকার- সে কি রকম ?

শওকত- বল দেখি পাপ কা’কে বলে ? আর পূণ্য কাকে বলে ?

খোন্দকার-আল্লাহ যা’ নিষেধ করেছেন, তাই পাপ; আর যা’ করতে বলেচেন, তাই পূণ্য ।

শওকত- আল্লা তো সব বিষয় বলে দেন নাই। নূতন নূতন বিষয়ে তবে পাপ –পূণ্য বুঝাবে কি কিরে ? 

খোন্দকার-আপনি বলুন। আপনি বিদ্যায় দরিয়া। মোল্লারা এসব বলতে পারে না ।

শওকত-যে-সব কাজের দ্বারা নিজের বা পরের শারীরিক,মানসিক অথবা আধ্যাত্মিক কোন প্রকার লাভ হয়, তারই নাম পূণ্য। তাই করা কর্তব্য। আর যে কাজের দ্বারা নিজের বা পরের কোন প্রকারের শারীরিক, মানসিক বা আধ্যাত্মিক ক্ষতি হয়, তার নাম পাপ। তা করা অকর্তব্য ।

খোন্দকার-হজুর ঠিক বলেচেন। ও, কি গভীর তত্ত্বকথা। এ তো কোন আলেমের কাছে শুনি নাই। এতদিনে আসল বুঝ পেলাম। এরুপ জ্ঞানগর্ভ কথোপকথন করিতে করিতে মগরেবের নামাজের ওয়াক্ত সমাগত দেখিয়া সকলে সান্ধোপসনায় নিয়ত হইলেন।

বিষয়: বিবিধ