সময় ও ইতিহাস হাত ধরাধরি করে তাদের নিজস্ব গতিতে চলে। চাইলেই একে আটকানো যায়
না কোন ফ্রেমে। সম্রাট ও স্বৈরশাসকদের নিযুত
প্রচেষ্টাও এখানে বিফল । তাই দেখা যায়, ইতিহাসের
ধারাবাহিকতায় তাদের সকল ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছেদ করে প্রকৃত সত্য সূর্যের ন্যায় মেঘের আড়াল থেকে হাসতে হাসতে বের
হয়ে আসে।
সকল ঘটনার অন্তরালেই থাকে না জানা অনেক ঘটনা। এসব ঘটনার খুব কমই মানুষের জ্ঞাতসারে
আসে। তাই সমাজ সচেতন সমাজ বিজ্ঞানীরা পৃথীবীর সকল ঘটনাকেই অভিহিত করেন রংগমঞ্চ হিসেবে।
তারা সব কিছুকেই দেখে শেক্সপিয়ারের নাট্যশালার মতো। তাই সাধারণ মানুষ যখন কোন বার্তা
শুনে কিংবা খবরে পুলকিত বা শিহরিত হন তখন অন্তরালের ওসব চালকেরা এসব দেখে অবজ্ঞার হাসি
হাসেন- গজমূর্খ, অজ্ঞের দল বলে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও এসব লুকোচুরি কম হয়নি। শুধু ১৯৭১ কেন। একাত্তর
পূর্ববর্তী ঘটনা নিয়েও লুকোচুরি কি কম হয়েছে। এমনি অসংখ্য লুকোচুরি ঘটনার একটি হচ্ছে
১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। যে মামলায় শেখ মুজিবসহ মোট ৩৫ জনের
বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান কে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথক করার অভিযোগ দায়ের করা
হয়।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকের পাতায় পাতায় কত কিছুই
না পড়লাম। কত কিছুই না শুনলাম মিডিয়ার কল্যাণে। পাকিস্তানের অত্যাচারের কথা। মামালার
বিষয়ে মিথ্যা অভিযোগের কথা। বাংলাদেশকে শোষন ও শাসনের কথা। শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তার
কথা। বাংলার ধন-সম্পদ পাকিস্তানে নিয়ে ভোগ করার কথা। এই মামলাকে কত ভাবেই না ষড়যন্ত্র
নামে অভিহিত করা হলো। বংগবন্ধু কে নির্দোষ দাবী করা হলো। এমন কি বংগবন্ধু নিজেকে নির্দোষ
দাবী করে আদালত প্রাঙ্গনে এক আগুন ঝরা বক্তৃতা দেন (http://www.somewhereinblog.net/blog/fix/29133232) । যদিও আওয়ামী লীগ
লিখিত এই ইতিহাসের রয়েছে নানান সমালোচনা, নানান বিতর্ক। রয়েছে পক্ষে বিপক্ষে অনেক কূটতর্ক
ও বাদানুবাদ (http://mukto-mona.net/Articles/n_manik/swadhinotar_itihas_4.htm)। তবু এত দিন কূটতার্কিকদের
কোন সমালোচনাই যেন বিশ্বাস করতে পারিনি।
কিন্তু এবার নিউক্লিয়ার বোম ফাটালেন
স্বয়ং জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার কর্ণেল শওকত আলী। তিনি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সিনেট ভবনেই নয় বরং ২০১১ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পয়েণ্ট অফ অর্ডারে
শেখ ফজলুল হক সেলিম এবং তোফায়েল হকের কথার প্রেক্ষিতে বলেন- “ওই সময় বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আমাদের (আসামিদের) বিরুদ্ধে যে অভিযোগ
পড়ে শুনানো হয়, তা সত্য ছিল। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন আমাদের ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির
করা হয়। ওই ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধুসহ আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় 'আসামিরা সশস্ত্র
পন্থায় ইস্টার্ন পার্ট অব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে
চায়।' মামলাটি ছিল 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা।' আমরা অন্যদের মধ্যে ছিলাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই আমরা এ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাম।"
(বিস্তারিত পড়তে- http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=50f0a48e0c1f60f822f218c3e419d1a4&nttl=30625)।
শুধু কি তাই। এখানেই কর্ণেল শওকত আলী ক্ষান্ত
হলেন না। তিনি রচনা করে ফেললেন- “সত্য মামলা আগরতলা” নামের ২০৮ পৃষ্ঠার এক মহাকাব্য।
আর তা প্রকাশ করল ‘প্রথমা’র মত প্রকাশনা। কি লজ্জা। এত দিন যাদের ইতিহাস লিখন, প্রচার
আর প্রপাগান্ডায় ‘আগরতলা মামলা’ কে ‘ষড়যন্ত্র মামলা’ বলে জেনে আসলাম তারাই এখন বলছেন
১৮০ ডিগ্রী কোণের বিপরীত কথা। বর্তমানের এসব ইতিহাস লেখক ও প্রকাশকদের বিশ্বাস করব
নাকি তাদের আগের কথা, প্রচারণা আর লিখিত ইতিহাসের কথা বিশ্বাস করব।

স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও আছে ঢের প্রশ্ন। একেক জনের একেক
মত। একেক বিশ্লেষকের একেক রকম বিশ্লেষণ। মত, অভিমত আর বিশ্লেষণের ঠেলায় আমরা চিড়া-চ্যাপ্টা।
তবু এত বিশ্লেষণ আর মতের মাঝে মন থেকে জামায়াতের স্বাধীনতা বিরোধীতার বিষয়টি কখনোই
দূর করতে পারিনি। যেমন বিশ্বাস করতে পারিনি তথাকথিত শত শত বইয়ের লিখিত কথা আর প্রচার-প্রপোগান্ডার
কথা, তেমনি পারিনি জামায়াতের বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীতার যুক্তি মেনে নিতে।
কিন্তু এবার বুঝি আর কোন দ্বিধা- দ্বন্দ, সন্দেহ-সংশয় থাকবেনা।
গত পাঁচ বছরে বর্তমান সরকার ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ক্ষেত্রে যে সাফল্য
(!) দেখিয়েছে এবং এক দিনের সফরেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা যা দেখালো তাতে এবার
মনের আর দোলায়মান অবস্থা থাকবেনা। গত মার্চে দায়িত্ব নেয়া সুজাতা নন কোন কেঊ-কেটা।
তিনি ভারতের সাধারণ এক জন সাধারণ বেতনভূক আমলা । প্রটোকল অনুযায়ী, তার সাক্ষাৎ করার
কথা ছিল আমদের পররাষ্ট্র সচিবের সাথে, খুব হলে, হাতে পায়ে ধরে, পররাষ্ট্র মন্ত্রীর
সাথে। কিন্তু কী দেখলাম আমরা! তিনি কথা বললেন, একে একে বিরোধী দলীয় নেতা, সরকার দলীয়
প্রধানমন্ত্রীসহ আমলা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে। যা চাইলেন, তিনি তাই পেলেন।
একেবারে যেন মামা বাড়ীর আবদার। (বিস্তারিতঃ http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article709646.bdnews)

তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর আর একাত্তরের চেতনা নিয়ে আমাদের
পূর্বের প্রচলিত সব বিশ্বাস পালটে ফেলতে হবে? আমদের সব জানা কি ভুল হয়ে যাবে? আমদের
চারপাশের সকল তথ্যই কি তাহলে শুধুই উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচার-প্রপাগান্ডা? সবই কি মরিচীকা?
ইতিহাসের হাজার হাজার পৃষ্ঠার লিখিত বিবরণীর সবই কি লেখকদের কল্পিত লেখা? কর্ণেল শওকত
আলীর মতই কোন মহাকবি এসে কি তাহলে রচনা করবে নতুন মহাকাব্য।
তাহলে জামায়াতের স্বাধীনতা বিরোধীতার কারণ কী যথার্থই ছিল? পিন্ডির
গোলামী ছেড়ে দিল্লীর গোলামী গ্রহণের যে ভয় ও শংকা জামায়াতের ছিল তা কী প্রকৃতই সত্য।
বন্ধুত্বের নামে প্রভুত্বগিরির গোপন ইচ্ছাই কী ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা করার
মূল কারণ? বাঙালী আর বাঙালীত্বের চেতনার নামে তাহলে ইসলাম বিরোধীতা করে হিন্দুত্ববাদী
রাম চরিত্র আমদানী করাই কী গোপন উদ্দেশ্য। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ কি তাহলে ছিল ১৯৪৭ সালের
বাংলা ভাগের প্রতিশোধস্বরূপ এবং দু’ বাংলা একত্রিতকরণের প্রাথমিক পদক্ষেপ।
তাই যদি হয়, তাহলে নতুন সেই লিখিতব্য ইতিহাসে স্বাধীনতার মহানায়কদের
স্থান কোথায় হবে? কারা হবে সেখানে নায়ক-মহানায়ক? আর কারাই হবে বিশ্বাসঘাতক? আর দল হিসেবে
আওয়ামী লীগ কিংবা জামায়াতের মূল্যায়ন কেমন হবে? কারা হবে রাজাকার- কারা হবে প্রকৃত
মুক্তিযোদ্ধা ? কারা হবে দেশপ্রেমিক কারা হবে দেশদ্রোহী?
তাহলে কি নতুন সে ইতিহাসে জামায়াত দল হিসেবে সবচেয়ে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন
দল হিসেবে পরিচিত হবে? জামায়াতের সব সিদ্ধান্তই কি তখন শত ভাগ সঠিক বলে বিবেচিত হবে?
জামায়াত ও তার নেতৃত্বকে কি তখন মরণোত্তর সংবর্ধনা দেয়া হবে? দেয়া হবে কি জাতীয় ও একুশে
পুরস্কার?
সেদিন, জানিনা থাকব কিনা?
দেখার সূযোগ হবে কিনা? তবে সাধ হয়- বর্তমান মিডিয়ার ভূমিকা কেমন হয় তা দেখার।
কিভাবে এই মিডিয়া তাদের রোল প্লে করে তা জানার। কিভাবে তারা একই সাথে ডুয়েল গেমের এই
খেলা এত সূচারু রূপে খেলতে পারে তা দর্শনের, উপভোগের ।
তবে আর যাই হোক, বিরাট এক নিরব বিপ্লব ঘটে
গেল ইসলামপন্থী দলের আন্দোলন ও রাজনীতিতে । আর এখানেই ভারত উপমহাদেশে ইসলামি আন্দোলনের
রুপকার জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগ আর সুজাতার পার্থক্য। জামায়াত মুক্তিযুদ্ধ আর একাত্তরের চেতনা নিয়ে প্রচলিত শত প্রচারণার
বিষয়ে হাজার হাজার শিবির- কর্মীদের যে সংশয় গত ত্রিশ বছরেও দূর করতে পারেনি তা দূর
করে দিল এবারের আওয়ামী লীগ সরকার। দেশের লক্ষ-কোটি তরুণ সমাজের যে প্রশ্নের উত্তর
জামায়াত দিতে পারে নি, যে মিথ্যা অভিযোগের প্রত্যুত্তর জামায়াত করতে পারে নি, যে ভুল
তাদের ভাঙতে পারে নি তা ভেঙে দিল সরকার প্রধান শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্র সচিব সুজাতার
(প্রধান মন্ত্রী সমমর্যাদার !!!) সফর। এখানেই সফলতা শেখ হাসিনার, সফলতা সুজাতা শিঙের।
কাজেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুজাতাদের এই নীতি
যদি অব্যাহত থাকে, কূটনীতিতে ভারতের এই ধর্ষকাম যদি চলতেই থাকে, বাংলাদেশ সরকার যদি
তার আনুগত্য বাংলাদেশের জনগণের পরিবর্তে দিল্লী সরকারের পদতলে জলাঞ্জলী দিতেই থাকে
তখন জামায়াত কে আর জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে না। জামায়াত হবে জনগণের স্বপক্ষের দল,
স্বধর্মের দল। জামায়াত তখন হবে দেশপ্রেমিক দল । সাধারণ মানুষের মুক্তিত্রাতা। মা্নুষের
দুঃখ- কষ্টের সংহারক। দেশের মাটি আর মানুষের দল। পিণ্ডি আর দিল্লীর গোলামি মুক্ত দল।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সব চেয়ে বেশি ভারসাম্য রক্ষাকারী দল।
সুজাতা জিন্দাবাদ! শেখ হাসিনা জিন্দাবাদ!!