কি শহর কি গ্রাম, কি
শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, ধর্মীয় বেত্তা কিংবা সেকিউলার সবাই নারী সম্পর্কে শুধুমাত্র প্রচলিত
ও চর্চিত কিছু বুলি আউড়ায়। এসবের অনেক কিছুই ধর্মীয় কিংবা মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে
একেবারেই সাপোর্টেড না। এসব দেখতে দেখতে, শুনতে
শুনতে কিছুটা ক্লান্ত ।
কিছু হুজুর তথা আলেমদের
বিয়ে ও নারীর অধিকার বিষয়ক কথাই ঠিক যতটা ক্লান্ত, তেমনি তথাকথিত নারীবাদীদের নারী অধিকারের নামে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রচেষ্টায়
ঠিক ততটাই ভীত। ফলে নারীর অধিকার কিংবা বিয়ে বিষয়ক বই পড়া হয় না অনেক দিন।
কানিজ ফাতেমা। কানাডা
প্রবাসী বাংলাদেশি। ব্লগ কিংবা ফেসবুকে পাঠক হবার সুবাদে পরিচিত একটি নাম। নারীবাদী
হলেও ইসলামিক পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে ব্যাখ্যা করার কারণে তার লিখা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল
অনেক আগেই। সেই সূযোগেই ব্লগ কিংবা ফেবু্তে ফলো করা।
রিসেন্টলি তার লিখা
একটি বইটি হাতে পেলাম- “বিয়ে ও পরিবার-সমকালীন জিজ্ঞাসা”। বইটি হাতে পেয়েই দৃষ্টি ফোকাসড
করলাম কিছু বিষয়ের উপর। সূচি উল্টেই চলে গেলেম ভিতরের পাতায়। কিছু বিষয় অন্য রকম ঠেকল।
পড়লাম। শেয়ার করলাম।
বাংলাদেশি কালচার, বাংলাদেশি
বিয়ে রেজিস্ট্রেশন আইন ও বিধিমালার গুরুত্বপূর্ণ অংশ সমূহ উল্লেখ এবং সেগুলোর ইসলামিক
পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে ব্যাখ্যাত বয়ান হাজির থাকায় বইটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী,
যুবক-যুবতী, নয়া কিংবা পুরানো কাপলদের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় পাঠ।
“তোমরা অত্যাচারী ও
অত্যাচারিত উভয়কেই সাহায্য কর।অত্যাচারিত কে সাহায্য কর অন্যায়ের হাত বাঁচার মাধ্যমে
আর অত্যাচারী কে সাহায্য কর তাকে তার অন্যায় কর্ম হতে বিরত রেখে”। এটি একটি বহুল প্রচলিত
হাদিস। আমাদের সমাজে- কি মুস্লিম কি অমুস্লিম- নারীরা তাদের অধিকার বঞ্চিত, শোষিত,
নিপীড়িত এবং শিক্ষার আলো থেকে দূরে। এই অবস্থার যে আর্থ-সামাজিক কিংবা নৃ-বৈজ্ঞানিক
ব্যাখ্যাই আমরা হাজির করিনা কেন, আল্টিমেটলি নারীদের তাতে কোন লাভ নেই। নারীরা প্রকৃতভাবে
লাভবান হবে যেদিন তারা প্রকৃতভাবে তারা তাদের মানবিক অধিকার ফিরে পাবে। ধর্মান্ধ, সেকিউলার,
নারীবাদী কিংবা নারীবিদ্বেষী যাকেই আমরা দোষারোপ করিনা কেন, আমাদের এই দোষারোপ নির্ণয়
কার্য নারীর কোন কল্যান সাধন করবেনা। তাই আমাদের উচিত নারীদের তার মানবিক অধিকার সমূহ
ফিরে দেয়া, প্রকৃত মানুষ হিসাবে তার যে হিস্যা তার সঠিক প্রত্যার্পন। আর এখানে আমাদের
নারী-পুরুষ উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে। নারী অধিকার বঞ্চিত হলে শুধু নারীই যে ক্ষতিগ্রস্থ-
তা নয়। বরং নারীকে অধিকার বঞ্চিত করার অভিযোগে পুরুষও অভিযুক্ত এবং তার প্রতিফলও কিন্তু
তাকে পেতে হবে। তাই সমাযে নারীর যথার্থ অবস্থান
নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুরুষও যাতে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ এবং তার কন্সিকুয়েন্সিয়াল
প্রতিফল হতে রেহাই পায়, তার ব্যবস্থা করা দরকার। আর তাই প্রয়োজন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে
বইটির একটি সরল পাঠ।
দেড়শ পৃষ্ঠার এই বইটি
আটটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত- ভূমিকা, বিয়ে বৈধ হবার শর্তাবলী, পাত্র বা পাত্রীর যোগ্যতা,
বাগদান, মোহরানা ও অর্থনৈতিক দায়িত্ব, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার, বহুবিবাহ ও নিকাহনামা।
বিষয়গুলো পরিচিত হলেও প্রতিটি অধ্যয়ের বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় তিনি সাম্প্রতিক সময়ের প্রখ্যাত
সকল আলেম-উলেমাদের জ্ঞান-তাত্ত্বিক আলোচনা, মন্তব্য ও মতামত/ ফতোয়া হাজির করে এক মুন্সিয়ানার
পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশী মুস্লিম সমাজে এই
বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত কিংবা অনুপস্থিত।
প্রফেসর আব্দুল হামিদ আবু সুলেমান, তারিক রামাদান, আল্লামা ইউসুফ কারযাভী, জামাল
বাদাবী, ড. আব্দুল ফাত্তাহ আশহুর, ড. ত্বহা যাবের আল আল-ওয়ানি ড. মোজাম্মিল এইচ সিদ্দিকী,
ড. আল্লামা আসাদ সহ আরো অনেক স্কলারদের মতামত কে আমাদের নিকট অনায়াস-লব্ধ করেছেন। আর
এ কাজ করতে গিয়ে তাকে নিতে হয়েছে Fiqh Counsil of
North America, European Counsil Fatwa and Research, On-Islam.net, Islam.online এর মত সব নামী-দামি
প্রতিষ্ঠানের সহায়তা।
আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ
সম্পর্কিত যে সমস্যা রয়েছে তার স্বরুপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘লেখকের কথা’ নিবন্ধে লেখক
নিজেই বলেছেন- “সমস্যার কারণ শুধু পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নারীদের মধ্যেও রয়েছে।
নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন না। এ সম্পর্কিত জ্ঞানের
অভাব যথেষ্ঠ পরিমাণে আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত। কোথায়-কতটুকু অধিকার রয়েছে এবং এ অধিকারের
সীমা কতদূর এটা না জানা থাকার কারণে সঠিক অবস্থান নেয়াও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে
সাংসারিক ও পারিবারিক জীবনে দেখা দেয় নানামুখী সমস্যা। এই নানামুখী সমস্যার বিভিন্ন
দিক কে তুলে ধরে এ সম্পর্কিত জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি করাই এ বইটির প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য।”
লেখিকার এই কথাটি পড়তে
গিয়ে আমাদের ছোট বোন শামিমা হোসেন নাইসের (লেকাচারার- ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এব্বং
সম্ভাবনাময়ী গবেষক) কথা আমার পড়ল। তার দাম্পত্য
জীবন নতুন। মানব জীবনে ইসলাম স্বীকৃত নারী-পুরুষের কিংবা স্বামী-স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কিত
বিষয়ে জানার জন্য অনেক বার ফোন দিলেও আমরা যেমন তথ্যের অভাবে তার সকল প্রশ্নের উত্তর
দিতে পারিনি তেমন অথেনটিক কোন বই-এর নামও রিফার করতে পারিনি। শোয়াইব ওয়েব.কম থেকে ইয়াসিন মোগাহেদ কিংবা আমিরী ইব্রাহিমীর
কিছু আর্টিকেল সর্বোচ্চ
রিফার করেছি। লেখক কানিজ ফাতিমা বিয়ে ও পরিবার সম্পর্কিত এসব সমকালীন যুগ-জিজ্ঞাসার
জবাবগুলো এক সাথে গ্রন্থিত করে তাই আমদের ঋণাবদ্ধ করে ফেলেছেন।
১২০/- টাকা মূল্যের
(মলাটে উল্লেখিত) এই বইটি আহসান পাবলিকেশন প্রকাশের (জানূয়ারি-২০১১ সাল) মাধ্যমে নিজ
দায়িত্ব পালন করে গোটা জাতির কাঁধে তা পাঠের এবং পাঠ পরবর্তী আমলের গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে
দিয়েছে।
বইটির ষষ্ঠ অধ্যায়ে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কিত আলোচনা করতে গিয়ে ১১৩ পৃষ্ঠায় লেখক উল্লেখ করেছেন-“ইস্লামি চিন্তাবিদগণ এ ব্যাপারে একমত যে, নারী-পুরুষ মানুষ হিসাবে সমান। কেউ উত্তম বা অধম নয়। (আল কুরান- ৪-১; ৭-১৮৯; ৩৩-৩৫; ৯-৭১)”। শুধুমাত্র নারী বা পুরুষ হবার কারণে কেউ শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারেনা। ইসলামে শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হলো –তাকওয়া। অর্থাৎ যে যত বেশি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের ক্ষেত্রে সচেতন সেই তত উত্তম। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তাকওয়ার দিক দিয়ে উত্তম”।
একই অধ্যায়ের ৭৫ নং পৃষ্ঠায় ‘স্বামীর নাম গ্রহণ’ পরিচ্ছেদে লেখক উল্লেখ করেছেন- স্বামীর নাম গ্রহণ একটি ওয়েস্টার্ণ কালচার। এ কালচারের মূলে রয়েছে পুরুষের সামনে নারীর অসহায়ত্ব বা পুরুষ নির্ভরশীলতা। ইসলাম এ সম্পর্কে কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেনি…তবে একজন আত্ম-মর্যাদা সম্পন্ন মুস্লিম নারীর জন্য এটাই মানানসই যে, সে নিজ নামেই সমাজে পরিচিত হবে… এমনকি রাসূল সা. এর স্ত্রীগণও তাদের নিজেদের নামেই পরিচিত, যেমন আয়েশা বিনতে আবু বকর রা..
একই অধ্যায়ের ৭০ নং পৃষ্ঠায় এক প্রশ্নের জবাবে ড. আব্দুল ফাত্তাহ আশহুর (Professor, Exegesis of the Quran, Al-Azhar Univesity) বয়ানে লেখক উদ্ধৃত করেছেন যে, “বস্তুত ইসলাম নারীকে সম্মান প্রদান করেছে এবং পুরুষের সমান মর্যাদা দান করেছে। উপরন্তু একজন নারী একজন পুরুষ কে ছাড়িয়ে যেতে পারে। একজন নারী যদি বেশি তাকওয়ার অধিকারি হন, বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদত করেন, নিজ ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করেন, তবে তিনি মর্যাদায় পুরুষ কেও ছাড়িয়ে যেতে পারেন।”
সর্বপরি লেখক কানিজ
ফাতেমা বইটি লিখে আধুনিক শিক্ষিত সমাজে বিবাহযোগ্য, বিয়ে পূর্ব, বিয়েকালীন কিংবা বিবাহোত্তর
সময়ে তরুণ-তরুণী, যুবক-যবতী, নয়া কাপল কিংবা পুরানো দম্পত্তিদের পারস্পরিক দায়িত্ববোধ
তৈরীর মাধ্যমে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে উপহার দেয়ার মত বিশ্বস্ত
ও নির্ভরযোগ্য বই এর যে ঘাটতি ছিল তা পূরণ করেছেন। বইটি পরিণত বয়সের ছেলে-মেয়েদের কিংবা
বিবাহোত্তর দম্পত্তিদের স্টাডি-সার্কেলের জন্য একটি রিফারেন্স বুক হতে পারে, নিঃসন্দেহে।
.............................................
............................................