Wednesday, September 18, 2013

বিয়ন্ড ইসলামিজম (Beyond Islamism)

মূল : তারেক রামাদান
অনুবাদ : আবু সুলাইমান

‘ইসলামিজম’ বা ‘পলিটিক্যাল ইসলাম' কোনোটাই মৃত নয়। যারা এর মৃত্যু ঘোষণা করছে অথবা ‘পলিটিক্যাল ইসলাম-পরবর্তী’ যুগের আগমনী বাঁশি বাজাচ্ছে তারা ভুল করছে। আর আফ্রিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা থেকে এটা স্পষ্টভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে। ইসলামিজম হারিয়ে যাওয়ার কিংবা মৌলিকভাবে পরিত্যক্ত বা রূপান্তরিত হওয়ার কোনো বিষয় নয়। আমার গবেষণা, আমার আদর্শিক অবস্থান, আমার আশা, এই যে, আমাদেরকে অবশ্যই ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’ বা ‘নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থার’ (ফরহাদ মজহারের পরিভাষায়) বৃত্তের বাইরে যেতে হবে এবং ‘ইসলামিজম’ কনসেপ্টের সব দিকের ওপর প্রচুর ‘অনুসন্ধানী গবেষণা’ করতে হবে। আমার এ অবস্থান ব্যাখ্যা দেয়ার আগে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আলোচনা করা দরকার। এসব বিষয়ে কনফিউশন এতই গভীর যে, আমাদের প্রথম দায়িত্ব এই বিষয়গুলোর ধারণা সুস্পষ্ট করা।

প্রথমত, মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড কিংবা তিউনিসিয়ার আন নাহদা তাদের নিজ নিজ দেশের নির্বাচনে বিজয় লাভ করে। সব গণতন্ত্রবাদীর অবশ্যই ব্যালট বাক্সের এ বিজয়কে শ্রদ্ধা করতে হবে। ইসলামপন্থীদের মতায়ন কিংবা সিদ্ধান্তের সাথে যে কেউ ভিন্ন মত প্রকাশ করতে পারে; কিন্তু কোনো কিছুই মিসরের এই সামরিক অভ্যুত্থানকে ন্যায্য প্রতিপাদন করতে পারে না; অর্থাৎ সামরিক জেনারেলদের ষড়যন্ত্র প্রত্যাখ্যান করে অসহিংস আন্দোলনকারীদের যে দাবি, তা সঠিক। এখানে মূল ইস্যু এই নয় যে, ইসলামপন্থীরা গণতান্ত্রিক আচরণ শিখতে পারেনি; বরং গণতন্ত্র স্বৈরশাসকের নিয়ন্ত্রণে আরো বেশি অনিরাপদ, যেমনটি দেখা গেছে বিগত ৬০ বছরে। অন্য দিকে তিউনিসিয়ায় নির্বাচিত সরকারের বিপে চরমপন্থী সালাফি বা সেকুলারিস্ট কারো ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম মেনে নেয়া যায় না। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে আদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে অন্যায়কে ন্যায় প্রতিপাদন করা যায় না। 

 দ্বিতীয়ত, পরিভাষাগত সমস্যা। এ বিষয়ে বিভ্রান্তি চরম, কেউই স্পষ্টভাবে জানে না ইসলামিজম কী? পরিভাষাটি এখন গালি অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং আলকায়েদা থেকে শুরু করে আন নাহদা, মুসলিম ব্রাদারহুড, তুরস্ক ও মরক্কোর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি এমনকি ইরানের বর্তমান শাসনকালকেও এ পরিভাষা দিয়ে বোঝানো যায়। এটি অবিশ্বাস্য যে, পরিভাষাগত এই যে বিভ্রান্তি, তাকে সুচিন্তিতভাবে জিইয়ে রাখা হচ্ছে, অথচ পরিভাষাটির সঠিক কোনো ইতিহাস নেয়। উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজাশাসিত দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠী যারা পশ্চিমা স্বার্থের সহযোগী মিত্র, যারা বলে ‘গণতন্ত্র হারাম’, যারা ইসলামকে তাদের নিজস্ব স্বার্থে আরিক অর্থে ও দমন-পীড়নের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে, নারীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বাইরে রাখেÑ যদিও তারা মূল নীতি ও কার্যগত দিক থেকে পলিটিক্যাল ইসলামের অনেক এজেন্ডারই বাস্তবায়নকারী তবুও তাদের কখনোই ‘ইসলামিস্ট’ হিসেবে চিত্রিত করা হয় না। তা ছাড়া বিভিন্ন ইসলামপন্থী পার্টি বা সংগঠনগুলোকেও সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা দরকার; ইসলামপন্থী দলের মধ্যে কিছু আছে শান্তিপূর্ণ, সংস্কারবাদী ও আইনানুসারী; অন্যরা আরিক ও গোঁড়া, বাকিরা সহিংস ও চরমপন্থী। এরূপে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িতকরণ ব্যতীত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক বা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। এই আর্টিকেলের মূল ল্য সংস্কারবাদী ও আইনানুসারী ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলো; তবে কিছু বিষয়ে সব ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলোর প্রসঙ্গ আসতে পারে (এ আলোচনার ভিত্তি হচ্ছে পলিটিক্যাল ইসলামবাদের সমর্থকেরা রাষ্ট্রমতায় আসীন হতে চায়)।

 সর্বশেষ, এটি পরিষ্কার যে, ‘ইসলামিজম’ বিষয়ে লিখিত আমার এ সমালোচনামূলক নিবন্ধ কোনোভাবেই ‘ইসলামিজমের’ বিরোধীরা যা বলে ও যে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে, তার সত্যায়ন নয়। ছয় দশকেরও বেশি ধরে স্ব-আরোপিত ‘লিবারেল’, ‘প্রগ্রেসিভ’, ‘সেকুলার’ এমনকি ‘বামপন্থীরা’ও (প্রতিটি পরিভাষা ইতিবাচকভাবে গৃহীত) চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে আপন আপন দেশকে সঙ্কট থেকে রা করার জন্য কোনো বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করতে। ‘পশ্চাৎমুখী ইসলামিস্টদের’ বিরোধিতা করাই কারো আদর্শিক বা বাস্তবিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য যথেষ্ট নয়। কার্যত কিছু কিছু ‘লিবারেল’ অংশ অতীতে স্বৈরশাসকদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে, পশ্চিমাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে তাদের নিজ নাগরিকদের বুঝতে। তারা প্রায়ই ক্ষেত্রে ‘ইসলামিস্টদের’ বিরুদ্ধে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে বিভাজন ও রাজনৈতিক প্রভাবের দীনতাকে আড়াল করেছে। এসব উদারতাবাদীর কোনো গণভিত্তি নেই এবং এ বিষয়ে তাদের দলনেতারা যথেষ্ট সচেতন। কাজেই ইসলামপন্থীদের (পূর্ববর্তী) সমালোচনা করার অর্থ এই নয় যে, ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে উদারতাবাদীদের (পরবর্তী) সব মতামত সঠিক। আর আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রাজনৈতিক সচেতনতার যে চরম সঙ্কট, তা তুলে ধরা। 
বর্তমানে ‘ইসলামিজম’ চিন্তার বাইরে যাওয়ার সময় হয়েছে। বিশ শতকের শুরুতে যখন মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ায় ‘ইসলামিজম’ চিন্তার উন্মেষ ঘটে, তখন ইসলামপন্থীদের তিনটি মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল : (ক) উপনিবেশ থেকে মুসলিমসমাজকে স্বাধীন করা, (খ) পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবেলা করে ইসলামকে সামনে আনা ও (গ) ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে দরিদ্র ও নির্যাতিতদের প্রাধিকার দিয়ে সামাজিক সুবিচারকে অবলম্বন করে যে মুক্তি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার থিসিস ও মৌলনীতিকে ব্যাখ্যা করা। ইসলামপন্থীরা ছিলেন ধর্মীয়ভাবে রণশীল, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে জনগণের কাছাকাছি এবং বিশ্বাস করতেন উপনিবেশের যে ‘বহুমুখী শোষণব্যবস্থা’ তা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে ‘জাতিরাষ্ট্র’। তাদের এ আন্দোলনের সাথে কেউ একমত পোষণ করুক বা না করুক, এটি দিয়ে কমপে তাদের আদর্শিক ও রাজনৈতিক পরিচিতি বোঝা যেত। বিশ্বব্যবস্থা পাল্টেছে। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডসহ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের কার্যক্রম বিশ্বব্যবস্থার সাথে সমানুপাতিক হারে পাল্টেনি। বিশ্ব ইতিহাসের উন্নয়নের যে গতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তনের যে গতি এবং গ্লোবালাইজেশনের যে নতুন ধারা; তার সাথে ইসলামপন্থী দলগুলো পুরোপুরি সঙ্গতি রা করতে পারেনি। তা ছাড়া বর্তমানে জাতিরাষ্ট্রের ‘মতার ধারণার’ পরিবর্তন ঘটেছে। যখন জাতিরাষ্ট্রের ধারণার উৎপত্তি ঘটে, তখন রাষ্ট্রমতাকে মনে করা হতো সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের একমাত্র নিয়ামক। আজ জাতিরাষ্ট্রের এই চরম মতার সমাপ্তি ঘটেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী অনেক ইসলামপন্থী আন্দোলনের মৌলিক উদ্দেশ্য ও কর্মকৌশলের মধ্যেও অনেক ভুল পরিবর্তন বাধ্যগতভাবে এসেছে। এসব ফ্যাক্টরের কারণে কালপরিক্রমায় ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলোর মধ্যে এক ধরনের অসংলগ্নতা সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা ব্যর্থ হয়েছে নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে। ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলো জাতীয়তাবাদী হওয়ায়, জাতিরাষ্ট্রের ধারণা তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ফলে তারা যেমন এক দিকে অবহেলা করেছে অর্থনৈতিক ইস্যু, কালচারাল ইস্যু; তেমনি আবার ব্যর্থ হয়েছে স্বাধীনতা, নাগরিকত্ব, ব্যক্তিক বিকাশের মতো মৌলিক প্রশ্নগুলোর সমাধান দিতে। বিরোধী দল হওয়ায় তারা নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণকে পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার কাজে। ফলে ইসলামপন্থীরা পরিণত হয়েছে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ গোষ্ঠীতে এবং ‘প্রয়োগবাদ’-এর নামে একের পর এক ইস্যুতে ‘আপসমূলক’ অবস্থান গ্রহণ করেছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের যে অমিত সম্ভাবনা ছিল তা নিষ্ফল করে তারা ‘রিলিজিয়াস রেফারেন্স’ অুক্ষুন্ন রেখেছে। ধর্মীয় গ্রন্থের নতুন ব্যাখ্যা থেকে আমরা কত দূরে অথবা জনগণের মুক্তির ‘ধর্মতত্ত্ব’ থেকে কত দূরে যেখানে থাকবে দরিদ্র ও নির্যাতিতদের প্রথম অগ্রাধিকার এবং যা সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ককে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিভাষা দিয়ে ব্যাখ্যা করবে। চলমান বিশ্বব্যবস্থায় উপহার দেয়ার মতো কোনো বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইসলামপন্থীদের কাছে নেই। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টায় বুঁদ হয়ে থাকায় প্রকট পুঁজিবাদী অর্থনীতির সামনে তারা মাথা নত করে রেখেছে। ধর্মের অনুসরণের ক্ষেত্রে তারা পশ্চিমা বিশ্ব ও পশ্চিমাদের ‘চরম স্বাধীনতার’ বিপরীতে হয়েছে অতি মাত্রায় ‘প্রতিক্রিয়াশীল ও গোঁড়া’। ফলে খুইয়েছে শিা, সামাজিক সুবিচার, পরিবেশ, কালচার ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনো নৈতিক সমাধান প্রস্তাব করার যোগ্যতা। দেখা গেছে, আবেগাশ্রয়ী, পরিচিতি সংশ্লিষ্ট অথবা নির্বাচনপদ্ধতির ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহারের ‘সস্তা জনপ্রিয় উদ্যোগ’ গ্রহণ করতে। 

তুরস্কের অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রশংসনীয়। তুরস্কের নেতাদের দতা ও প্রায়োগিক যোগ্যতা উল্লেখ করার মতো (পাশাপাশি জনগণের মৌলিক কিছু স্বাধীনতা হরণ ও মতা কুগিত করার যে মানসিকতা, তা অবশ্যই সমালোচনাযোগ্য)। এটি ভালো যে মিসর ও তিউনিসিয়ায় ইসলামিস্টদের চিন্তার কিছু উন্নয়ন ঘটছে অথবা ধর্মভিত্তিক ইসলামিক স্টেটের পরিবর্তে সিভিল স্টেটের উদ্ভবের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকছে কেবল স্লোগানে ও মতা গ্রহণের মধ্যে এবং সেখানে সুস্পষ্ট, মৌলিক ও উদ্ভাবনী রাজনৈতিক প্রকল্পের ঘাটতি রয়েছে। আইনানুসারী ও রণশীল ইসলামিস্টদের কার্যক্রমে উল্লেখ করার মতো কিছু নেই। বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন আনার মতো সামর্থ্য তাদের নেই; বরং বিরোধী প যতটুকু ভালো বা মন্দ মতো করার সামর্থ্য রাখে, তারাও তেমনি।

এখন উচিত আমাদের অগ্রাধিকার তালিকা পুনঃনিরীণ করা, গতিপথ পুনর্নির্ধারণ করা। এখন উচিত ‘নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থার’ অতিমাত্রিক রাজনীতিকীকরণ বন্ধ করা। শতাব্দীব্যাপী রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করে এবং বিগত কয়েক দশক মতা নিজে ব্যবহার করে ‘ইসলামিজম’ বর্তমানে একটি মধ্যপন্থা ও ব্যবস্থাপনার ‘আদর্শ’-তে পরিণত হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীলভাবে পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরোধিতা কিংবা নিজেদের মধ্যে শত্রু তৈরি করা ছাড়া বৃহত্তর পরিসরে উপহার দেয়ার মতো এখানে আর কিছু নেই। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো যত দিন এরূপ নিয়ন্ত্রণপ্রবণ ও প্রতিক্রিয়াশীল ভিশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, তত দিন তারা নিজেদের ‘মুক্ত’ করতে পারবে না। বিশ্বাস, ধর্ম আর আইনের ‘বায়বীয় ধারণার’ পুরোপুরি বাইরে এসে জনগণের প্রকৃত মুক্তির, আত্মমর্যাদার ও আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজনের কথা শুনতে হবে। আমাদের সামনে মূল কাজ হচ্ছে মানুষের কর্মের প্রকৃত ল্য নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করা এবং বর্তমানের অবিচার ও অমানবিক বিশ্বব্যবস্থার একমাত্র প্রকৃত বিকল্প হিসেবে ব্যক্তিক ও সামাজিক নৈতিকতার একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করা। স্বাধীনতা, সুবিচার, আত্মমর্যাদা ও মানবমুক্তির প্রয়োজন কখনোই এখানে বৃহত্তর হয়ে ওঠেনি; আজকের মুসলমানদের সব বিষয়ে প্রয়োজন সার্বিক ও সমন্বিত দর্শন। 

 ‘নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থা’ মুসলমানদের যে আজ সব বিষয়েই বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মধ্যে হাজির করেছে, সেখান থেকে তাদের মুক্তি আবশ্যক। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো আজ তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের জন্য হাহাকার করছে; যে বিপ্লব হবে অন্তর্গত দিক থেকে মৌলিক এবং ল্যমাত্রার দিক থেকে নজিরবিহীন। মতা চর্চাকারী এবং ক্ষুদ্র  রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে দূরে থেকে আমাদের ইসলামি সভ্যতার যে প্রকৃত ঐতিহ্য ও সম্পদ যা মানবমর্যাদা, স্বাধীনতা, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তার আইন তৈরি করে তার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে। আজকের মুসলিম জনগণের নিজেদের পুনঃমূল্যায়ন জরুরি। আর এ প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা ও মিস্টিসিজম। সুফিবাদের সে নির্দিষ্ট ফর্মের কথা বলছি না, যা ‘রাজনীতিতে অংশ নিতে’ চাই না এবং শেষ পর্যন্ত মতা চর্চার (এবং মতা চর্চাকারীদের) খেলার মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে যায়; বরং এমন খাঁটি সুফিবাদ যা মানুষের মানবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক (সুবিবেচক ও ন্যায়বিচারক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে) কার্যক্রম থেকে অবিচ্ছিন্ন।

 স্বাধীনতাকে শরিয়াহর মাধ্যমে নিশ্চিত করাই যথেষ্ট নই; বরং আধুনিক সময়ের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘স্বাধীনতার’ পূর্ণ অনুধাবন দরকার। শরিয়াহর উচ্চতর উদ্দেশ্যকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে ‘ঈশ্বরের অধরা আইন হিসেবে পরিচিত যে হ্রাসপ্রাপ্ত প্রবিধান’ তার ওপর। আর এ বিষয় ইমাম আস-সাতিবি ‘শরিয়াহর উদ্দেশ্য’ শীর্ষক লেখায় তুলে ধরেছেন। তার মতে, মূলত শরিয়াহর উদ্দেশ্যই হচ্ছে ‘আইনের দর্শন’ এবং এ বিষয়টি অবশ্যই ‘স্বাধীনতার ধারণার’ জন্য চিন্তা করতে হবে। আমাদের এমন একটি ‘স্বাধীনতা দর্শন’ প্রয়োজন, যা হবে না সঙ্কুচিত, প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা গোঁড়া; বরং তা হবে নারী ও পুরুষ সবার জন্য সমভাবে বিস্তৃত, হোলিস্টিক ও মুক্তিদায়ী। পুরুষ ও নারী উভয় গ্রুপ থেকে তরুণ আলেম বা পণ্ডিত এবং বুদ্ধিজীবী প্রয়োজন, যারা কিঞ্চিৎ হলেও সাহস প্রদর্শন করবেন। তরুণ বুদ্ধিজীবীদের ইসলামের মৌলিক বার্তা আর নিয়মের প্রতি সশ্রদ্ধ থাকতে হবে। পাশাপাশি পুরনো ইসলামি ঐতিহ্যকে যারা শক্তি জুগিয়েছেন তাদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অবশ্যই পুনর্মিলনের পথ খুঁজতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান তরুণদের তৈরি করেছে, যেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং চিন্তাগতভাবে দুর্বল (যেমনÑ আল আজহার বা উম্মুল কুরআ) সেসবের নিয়ন্ত্রণ থেকে তাদের মুক্ত হতে হবে। শুধু নিষ্ক্রিয় দর্শক না হয়ে তাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে এবং সিভিল সোসাইটির ডাইনামিকসে নতুন অর্থ দেয়ার মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি প্রমাণ করতে হবে। তরুণ বুদ্ধিজীবীদের নতুন নতুন ক্ষেত্র বের করতে হবে, নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে এবং নতুনভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। নিজেদের আত্মবিশ্বাসী রেখে প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থাকে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে। 

যদিও চ্যালেঞ্জ বিশাল, তবুও রাজনীতির আবেশ থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে, একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের উচিত কিভাবে প্রভাবশালী অর্থনীতির বিকল্প ‘পাল্টাশক্তি’ হিসেবে শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলনের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক ও শিল্পসম্মত সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে মানুষের মুক্তির পথ উন্মুক্ত করে তা সুস্পষ্ট করা। স্বায়ত্তশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে একটি সাধারণ চূড়ান্ত লক্ষ্য প্রস্তাবের এবং বৈশ্বিক ভিশন উন্নয়ন করার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণভাবে যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা, তা আমি এখানে উল্লেখ করেছি। শিয়া-সুন্নি এবং সঙ্ঘাতমুখী বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের প্রশ্নকে গুরুত্ব দেয়া দরকার। যেসব ঘটনা এ বিভাজনের ক্ষেত্রে  ইন্ধন জোগায়, সেগুলো গুরুতর; কিন্তু স্পষ্টত হাস্যকর। বর্তমানের স্কলার, মুক্ত বুদ্ধিজীবী, কর্মীদের আবশ্যিকভাবে এ ফাঁদ থেকে দূরে থাকতে হবে (অথচ ইসলামিস্টরা এক্ষেত্রে নিজের নাক কেটে হলেও অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করে)। 

শুধু উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করাই নয়, বরং ‘ইসলাম বনাম পশ্চিম’ যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছে, তাকেও সরিয়ে ফেলা জরুরি। ল্যাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার সাথে শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক অংশীদারিত্বের যে সম্ভাবনা, তার অন্বেষণ অত্যাবশ্যক। মুসলিমদের যে পূর্বতন ধারণা ‘সব জ্ঞান তার নিজের তৈরি হতে হবে, উৎস যাই হোক না কেন’ তা আজ পরিত্যক্ত হয়েছে। মুসলমানেরা নিজেরাই অন্তর্গত দিক থেকে বদলেছে। অন্যান্য সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সামাজিক কাঠামোকে অধ্যয়ন করতে, এর সাথে আদান-প্রদান উৎসাহিত করতে না পারার ব্যর্থতায় সেখান থেকে কোনো লাভ পায়নি; বরং মুসলমানেরা দিন দিন আরো দুর্বল হয়েছে। ইসলামিস্টরাও এর ব্যতিক্রম নন। উত্তরের দিকে আবিষ্ট থেকে তারা বিভ্রান্ত হয়েছে এবং দক্ষিণকেও হারিয়েছে (কেন্দ্রের কিবলা থেকে পরিধির সব বিন্দুর দূরত্ব এবং মান কি একই নয়?)। 

আজকের ইসলামিস্টরা একটি রক্ষণশীল ভূমিকা গ্রহণ করছে, যা কেবল অভিযোজিত হতে চায়। সমসাময়িক মুসলিম মননকে অবশ্যই এই রক্ষণশীল অবস্থান থেকে মুক্ত হতে হবে এবং তাদের ইসলামের ঐতিহ্যের মধ্যে মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতার জন্য যে সংস্কারবাদী ও প্রাক-বৈপ্লবিক শক্তি নিহিত রয়েছে, তার প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনঃমূল্যায়ন করতে হবে। আর এই ঐতিহ্য একই সাথে 'ভেতর' ও 'বাহির' উভয়ের সাথে সমভাবে পুনর্মিলনের আহ্বান জানায়। এক চক্র শেষ হয়, নতুন চক্র উঁকি দেয়। আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের সাথে অধিক পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে, আমাদের অগ্রাধিকার সংজ্ঞায়িত করার মাধ্যমে এবং আমাদের কাছে যে নতুন সরঞ্জাম রয়েছে, তার সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের যে লক্ষ্য -স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা ও মুক্তি- তা অর্জন করতে সক্ষম হবো। প্রচলিত এ প্যারাডক্সটি আজ মুসলমানদের জন্য সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, "আজকের আত্মবিশ্বাসহীন মুসলমানেরা হচ্ছেন এমন দ্বার-রক্ষক যারা  নিজেদের কম্পিত হাতে ধারণ করে আছে তাদের নিজের কারাগারের চাবি।"

source: http://www.dailynayadiganta.com/welcome/post/14706#.UidUun898VR
Main Article: http://tariqramadan.com/spip.php?article13030&lang=en